শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল -|- ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি
hridoyechattogram.com - news@hridoyechattogram.com - www.facebook.com/hridoyechattogram/

পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চাকমা জাতির ইতিহাস।

প্রকাশিত হয়েছে- মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই, ২০২০

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বৃহৎ উপজাতি জনগোষ্ঠী চাকমাদের ইতিহাস সম্পর্কে অনেকেই জানতে চান।
বস্তুত একটি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস জানার জন্য যে ঐতিহাসিক ভিত্তি এবং প্রামাণ্য দলিল প্রয়োজন চাকমা জাতির ইতিহাস বিচারের ক্ষেত্রে সেরকম অকাট্য প্রামাণ্য দলিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

তারপরেও চাকমা জাতির ইতিহাস সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যে উপকরণগুলো বিবেচনা করা যায় তন্মধ্যে
১.পৌরাণিক কাহিনী
২.আরকান-চট্টগ্রাম সীমান্তের জনশ্রুতি ভিত্তিক ইতি কাহিনী।
৩.ব্রহ্ম-আরকান ইতিহাস সম্পৃক্ত তথাকথিত চাকমা ইতিহাস
৪. বিজয় গিরীর লোককাহিনী
৫. প্রচলিত জনশ্রুতি
৬. আধুনিক কালের প্রামাণ্য দলিল ও চিঠিপত্র।

সমস্যা হল উপমহাদেশে ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে শক্তিশালী ইতিহাস চর্চার ভিত্তি তৈরি হয়নি যার দরুন প্রতিটি জাতিসত্তার হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনার ক্ষেত্রে অনেকটা যুক্তি নির্ভর অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়।

পৌরাণিক লোক কাহিনী ও প্রচলিত জনশ্রুতির উপর ভিত্তি করে চাকমা জাতির একটি সুদীর্ঘকালের প্রচলিত ইতিহাস রচিত হয়েছে। যার রূপরেখাটি এইরকমঃ
সূর্যপুত্র বৈবস্বত মনু যার বংশধর মহাবীর ইক্ষাকু, সাগর, ভগিরথ, রঘু, নবরুপি, নারায়ন, শ্রীরামচন্দ্র প্রভৃতি সূর্যবংশীয় নরপতি বৃন্দ। এই বংশধারা থেকে উদ্ভূত এক শাখা শাক্য বংশে জন্মগ্রহণ করেন শাক্য কুল সিংহ সিদ্ধার্থ বা গৌতম বুদ্ধ।

শাক্য বংশের অপর এক শাখার ‘শাক্য’ নামীয় জৈনক রাজা হিমালয়ের পাদদেশে কলাপ নগরে তার রাজধানী স্থাপন করেন। পরে চম্পাকলি নামে জৈনক রাজা কলাপ নগর থেকে তার রাজধানী চম্পকনগর স্থানান্তরিত করেন।

চাকমাগণের আদি রাজা বলে কথিত রাজা বিজয়গিরি এই চম্পা কলির উত্তরপুরুষ।

যুবরাজ থাকাকালেই বিজয়গিরি রাজ্য জয় করার মানসে তার সেনাপতি রাধামোহন কে সাথে নিয়ে দক্ষিণ অভিমুখে যাত্রা করেন এবং ক্রমে ক্রমে মগ দেশ, অক্সাদেশ, কাঞ্চননগর, কালাঞ্জর প্রভৃতি দেশ জয় করার পর স্বরাজ্যে ফেরার কালে পথিমধ্যে শুনতে পান যে ইতিমধ্যে তার পিতার মৃত্যু হয়েছে এবং রাজার অবর্তমানে রাজ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টির আশঙ্কায় প্রজাবৃন্দ কনিষ্ঠ রাজপুত্র সমরগিরি কে সিংহাসনে বসিয়েছে।

তখন ক্ষোভে দুঃখে বিজয়গিরি স্বরাজ্যে ফিরে না গিয়ে তার জয় করা রাজ্য সাপ্রেইকুল ফিরে যান এবং নতুন এক চাকমা রাজ্যের পতন করেন।

তার পরবর্তী রাজাই চাকমা গণের কীর্তিমান রাজা বলে কথিত সিরিত্তমা এই বংশের মানিকগিরি নামে এক রাজা পুরাতন রাজধানী থেকে উচ্চব্রহ্মে সরে গিয়ে নিজের নাম অনুসারে নতুন রাজধানী মাইচাগিরির পত্তন করেন।

ইতিমধ্যে আরকান রাজও বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠায় ক্ষমতা নিয়ে উভয় রাজার দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে আরকান রাজ মেংদি উচ্চ ব্রহ্মের চাকমা রাজার বিরুদ্ধে বিশাল এক সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন এবং কূটকৌশলে চাকমা রাজ ইয়াংজকে পরাজিত করেন।

আরাকান রাজ তাকে সহ তিন রাজপুত্র, রাজকন্যা এবং অারো দশ হাজার প্রজাকে বন্দি করে নিয়ে আসেন।

বন্দী প্রজাদের দৈংনাক আখ্যা দিয়ে আরকানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করার অনুমতি দেওয়া হয়। রাজকুমারী চমিখাকে আরকান রাজ নিজেই বিয়ে করেন। এভাবে উচ্চ ব্রহ্মের চাকমা রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর জ্যৈষ্ঠ রাজকুমার চজুং সুযোগ বুঝে পালিয়ে গিয়ে পুনরায় উচ্চব্রহ্মে ‘মং জাম্রু” নতুন এক রাজধানী পত্তন করেন।

চজুংর মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র মৈসাং এর আমলে পুনরায় আরকান রাজ “মং জাম্রু” আক্রমণ করে তাকে ধ্বংস করে ফেলেন।
নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে ১৭১৩ সাল পর্যন্ত আরকান রাজের সাথে চাকমা রাজের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
পরবর্তীতে চাকমা রাজা জালাল খাঁ ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট ফররুখ শিয়ারের সাথে বাণিজ্য চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এই সময় থেকে পরবর্তী ইতিহাস আধুনিক কালের।

তবে এসব অনুমাননির্ভর’ ইতিহাস কতটুকু সত্য এবং এই ইতিহাস থেকে কতটুকু গ্রহণ করা যায় সেটা অাধুনিক কালের বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তাধারার ইতিবৃত্তকারগনের নিকট প্রশ্ন থেকে যায়।
এখানে আধুনিককালের ইতিহাস এবং প্রামাণ্য দলিল অনুযায়ী চাকমা জাতির অতি সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসটা বর্ননা করছি।
আঠারোশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অর্থাৎ ১৭৩৫ সালের দিকে উত্তর আরাকানের পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় মগ এবং চাকমা সম্প্রদায়ের মাঝে ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে।

রাজ শক্তির সহায়তা প্রাপ্ত মগদের দ্বারা চাকমা জনগোষ্ঠির লোকেরা ভীষণভাবে নাস্তানাবুদ হয় এবং মগ নিপীড়নের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য জৈনক শের মস্ত খাঁর নেতৃত্বে চাকমাদের একটা অংশ চট্টগ্রাম অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে।

সেই সময় চাকমাদের অধিপতি ছিল মৈসাং নামের চাকমা নৃপতি। চাকমা জনগোষ্ঠীর একটি অংশ তাদের সাথে ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানালে তাতে মৈসাং অস্বীকৃতি জানায় এবং পরবর্তীতে মগ আক্রমণে সে নিহত হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় চাকমা জনগোষ্ঠীর একটি অংশ শের মস্ত খাঁর নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোগল শাসক জুল কদর খাঁনের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে।

তিনি তাদের দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার কোদালা উপত্যকায় ১৭৩৭ সালে একখণ্ড অনাবাদি পাহাড়ি জমি বন্দোবস্ত দান করেন। যে জায়গাটি শের মস্ত খাঁর পোষ্যপুত্র শুকদেব রায়ের নামে নামকরণ করা হয়। সেখানকার রাজস্থলী, শুকবিলাশ,রাজভিলা এলাকা তারই বর্ধিত অঞ্চল।

এটিই ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের প্রথম আগমন এবং তারা সংখ্যায় ছিল অতি নগন্য। চাকমা লোকগীতিতে শের মস্ত খাঁকে নিম্নাকারে বর্ণনা করা হয়—
আদি রাজা শের মস্ত খা
রোসাং ছিল বাড়ি
তারপর শুকদেব রায় আসি
বান্ধে জমিদারি।।

বার্মার নাফ নদীর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত রোসাং রাজ্যের উত্তরাংশে কালাদন নদীর পাড়ে কথিত মাইসাগিরি অঞ্চল ছিল চাকমা অধ্যুষিত এলাকা।

চাকমা প্রতিপত্তি ও চাকমাদের স্বাধীন আচরনে রোসাং রাজ ও শাসক গোষ্ঠী তাদের আনুগত্যের প্রতি সন্ধিহান হয়ে পড়েন। আর এই কারণেই এক সময় চাকমারা আক্রান্ত হয় এবং সেখান থেকে চাকমাদের উৎখাত করা হয়। তারপর চাকমাদের একটি অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম বনাঞ্চল আশ্রয় গ্রহণ করে।

১৮৮৪-৮৫ খ্রিস্টাব্দে আরাকানে বার্মার অন্যান্য আভারাজ্য কর্তৃক আক্রমণের ফলে আরকান থেকে মোটাদাগে চাকমা, মগসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে।

আধুনিককালের এই ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আঠারো শতকের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের কোন বসতি ছিল না। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি আশ্রিত জনগোষ্ঠী যাদের ব্রিটিশ সরকার অভিবাসন আইনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসের জন্য অনুমতি প্রদান করে।

তথ্য সূত্রঃ চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার,অশোক কুমার দেওয়ান
প্রান্তিক উপজাতি ও আদিবাসী, আতিকুর রহমান।
চাকমা জাতি,সতীশচন্দ্র ঘোষ(১৯০৯)

আহাম্মদ রিদোয়ান: 
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক লেখক ও গবেষক