আজ ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মো. এরশাদ আলম, লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম)
অনেক নির্লজ্জ, বেহায়া, মিথ্যাবাদী মানুষকে দেখেছি যারা অবলীলায় যে কোনো পরিস্থিতিতে মিথ্যা রচনা করতে পারেন, মিথ্যা কথা নির্ভয়ে বলতেও পারেন। আবার একটি মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আরও অসংখ্য মিথ্যার অবতারণা করতেও এদের ভয়, লজ্জা, দুশ্চিন্তা কিছুই হয় না। এরা নিজের জন্য হোক কিংবা অন্যের জন্য হোক মিথ্যা বলায় চরম ওস্তাদ। আপনারা নিশ্চয়ই মিথ্যাচারের অনেক গল্প শুনেছেন। ছোট-বড় এবং কত রকমের মিথ্যা রয়েছে তা মিথ্যাবাদিরা ভালোই জানেন। এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে কয়েকটি ছোট ঘটনা উল্লেখ করতে চাচ্ছি।
এই চাকুরিতে আসার আগে আমি একটা ব্যাংকে চাকুরি করতাম। সেখানকার একজন অফিস সহায়ক কয়েকদিন পরপর তার চাচা, মামা, খালু মারা গিয়েছেন বলে ছুটি চাইতেন। আমার সিনিয়র কলিগদের কেউ কেউ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতেন, অনেক সময় বকাও দিতেন। তার ছুটি চাওয়ার কারণগুলো সঠিক ছিল কি না, আমি কখনো তা ঘাটতে যাইনি। তবে ছুটি নেওয়ার জন্য তিনি অনেক অজুহাত দেখাতেন, যা আমিও বুঝতে পেরেছি!
সেদিন এক স্কুলে অভিযান পরিচালনাকালে স্কুল সংলগ্ন রাস্তায় এক ছাত্রকে সে কোন স্কুলের ছাত্র জিজ্ঞাসা করতেই বলে ফেললো, “আমি এই স্কুলের ছাত্র নই।” অন্য একটি স্কুলের নাম বললো। পরে বললাম, চলো, তোমার স্কুলে গিয়ে দেখি, তুমি ওখানকার ছাত্র কি না। তখনই সে হঠাৎ মোড় নিলো এবং বলতে লাগলো, “না স্যার, না স্যার, আমি এই স্কুলেরই ছাত্র। আমি ক্লাস নাইনে পড়ি।” তারপর তার ক্লাস টিচারের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, সে এই স্কুলেরই ছাত্র! অথচ প্রথমে সে অন্য স্কুলের ছাত্র বলেছে এবং ক্লাস এইটের ছাত্র বলেছিলো। একইদিন রাস্তায় এক জোড়া ছেলে-মেয়েকে সন্দেহের বশত জানতে চাইলাম, তোমাদের সম্পর্ক কী? তোমরা কোথায় যাচ্ছো? তখন দুইজনই দাবি করলো, তারা খালাতো ভাই-বোন। প্রতিদিন ছেলেটি নাকি তার বোনকে বাড়ি থেকে স্কুলে দিয়ে আসে, আর স্কুল শেষে স্কুল থেকে নিয়ে বাড়িতে দিয়ে আসে। অথচ পরে যাচাই করে জানা গেল তারা কোনো আত্মীয় নয়! তারা সম্পূর্ণই মিথ্যা বলেছিলো।
একবার এসএসসি পরীক্ষার হলে ম্যাজিস্টেরিয়াল দায়িত্ব পালনকালে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করার কাজে পরীক্ষার্থীদের সহায়তাকালে একজন শিক্ষককে প্রমাণসহ হাতেনাতে ধরার পরেও তিনি অস্বীকার করছিলেন এবং ডকুমেন্টস লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছিলেন। পরে অবশ্য অন্য একজন শিক্ষকের উপস্থিতিতে তার প্রচেষ্টায় ওনার অসৎ কর্ম প্রমাণিত হয়েছে।
আমার এক ড্রাইভারকে একবার এক জায়গায় সরাসরি গিয়ে একটা বিষয় আমাকে জানাতে বলেছিলাম। কিন্তু সে সেখানে না গিয়ে একজনের কাছ থেকে ফোনে তথ্য নিয়ে আমাকে জানিয়েছে। অথচ আমাকে বললো, “আমি সেখানে গিয়েছি।” পরে যখন ঐ বিষয় নিয়ে একটা সমস্যা হয়ে তৈরি হলো, তখন প্রমাণ হলো যে সে সেখানে না গিয়েই আমাকে তথ্য দিয়েছে!
বর্ণিত ঘটনাগুলো সম্পূর্ণ সত্য। আপনাদের নিশ্চয়ই রাখাল ও বাঘের গল্পটি মনে থাকার কথা। বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে বলে রাখাল চিৎকার দিয়ে কয়েকদিন এলাকাবাসীকে হাজির করে মজা নিয়েছিলো, কিন্তু একদিন সত্যি সত্যি বাঘ এসে রাখালকে খেয়ে ফেলেছে! অথচ সেদিন আর তার চিৎকারে কেউ আসেনি!
একথা স্বীকৃত যে, মিথ্যার পরিণতি অনেক ভয়াবহ। কুরআন হাদীসের দৃষ্টিতেও মিথ্যা বলা মহাপাপ। আল্লাহ মিথ্যাবাদীকে অত্যন্ত ঘৃণা করেন। যারা মিথ্যাবাদী, তারা এতে সাময়িক সুবিধা পেলেও ইহকালে এরা নিন্দিত হবে এবং পরকালে পাবে কঠিন শাস্তি। অন্যদিকে সত্যবাদিতা মানুষকে যে মর্যাদার স্থানে নিয়ে যায়, যে আত্মবিশ্বাস, শক্তি ও সাহস দেয় তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। যারা সত্যবাদী বলে স্বীকৃত এবং যিনি আসলেই সত্যের চর্চা করেন তাঁর অবস্থান কিন্তু পরিবার ও সমাজে অনেক উঁচুতে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদিতা হচ্ছে শুভ কাজ আর শুভ কাজ জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। আর বান্দা যখন সত্য বলতে থাকে, এক সময় আল্লাহর কাছে সে সত্যবাদী হিসেবে পরিচিত হয়। আর মিথ্যা হচ্ছে পাপাচার, পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়, বান্দা যখন মিথ্যা বলতে থাকে, আল্লাহর কাছে এক সময় সে মিথ্যুক হিসেবে গণ্য হয়’। (বুখারি : ৫৭৪৩, মুসলিম : ২৬০৭)।
বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানীর গল্প নিশ্চয়ই অনেকে শুনেছেন। তাঁর সত্যবাদিতা ও মায়ের উপদেশ পালনে মুগ্ধ হয়ে, ডাকাতের দল ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে সত্যের পথে ফিরে আসেন। গুণীদের মতে সততা সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। বলা হয়ে থাকে চরিত্র মানবজীবনের মুকুটস্বরূপ। অনেক মা-বাবা, শিক্ষক, গুরুজনরা যখন তাদের বাচ্চাদের বা শিষ্যদের সাথে কিংবা তাদের সামনে অকপটে অন্যের সাথে ডাঁহা মিথ্যা কথা বলে থাকেন অথবা বানোয়াট কথা বলেন থাকে তখন আমাদের কোমলমতি বাচ্চারা বা শিক্ষার্থীরা কী শিক্ষা গ্রহণ করবে, তা সহজেই অনুমেয়!