আজ ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রাচ্যের রাণী খ্যাত চট্টগ্রাম বাংলাদেশ তথা এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী এবং প্রত্নসম্পদ সমৃদ্ধ এক সুপ্রাচীন জনপদ। বাংলার প্রাচীন ইতিহাসে এ চট্টগ্রামের নামের পরিবর্তন হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে ৩৭ বার। যথাক্রমে আদর্শদেশ,সুহ্মদেশ,ক্লীং বা কালেন,রম্যভূমি, চিতাগাঁও, চিৎগাঁও, চট্টল, চৈত্যগ্রাম, সপ্তগ্রাম, চট্টলা, চট্টগ্রাম, চক্রশালা, চন্দ্রনাথ, চরতল, চিতাগঞ্জ, চটীগাঁ, শ্রীচট্টল, সাতগাঁও, সীতাগঙ্গা (সীতাগাঙ্গ), সতের কাউন, পুষ্পপুর, রামেশ, কর্ণবুল, সহরেসবুজ, পার্ব্বতী, খোর্দ্দ-আবাদ, porti grando (বৃহৎ বন্দর), ফতেয়াবাদ, আনক, রোশাং, ইসলামাবাদ, মগরাজ্য, Chittagong, কিরাত, যতরকুল, চক্রশা, কেলিশহর, পেন্টপোলিস।
চট্টগ্রাম বিশ্বের সু-প্রাচীন জনপদ সমূহের একটি হিসেবে ঐতিহাসিক ও ভৌগলিকভাবে প্রমাণিত ও স্বীকৃত। এটা বাংলার বাবে ইসলাম বা ইসলামের দ্বার হিসাবে খ্যাত। প্রাচীন এই চট্টগ্রামের মাটিতে আরব দেশ হতে নবী করীম (সা) এর পবিত্র ইসলাম ধর্মের আগমনী বার্তা নিয়ে এদেশের চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষকে ধন্য করেছিলেন মহানবীর সাহাবীগণ। মহানবী (সা) এর জীবদ্দশায় ইসলাম প্রচারের নিমিত্তে সাহাবায়ে কেরামের (রা.) একটি দল হাবশা বা আবিসিনিয়ায় পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি হাবশার বাণিজ্য কেন্দ্রটিকে পূর্ণ মাত্রায় দ্বীন প্রচারে ব্যবহার করতেন। সাহাবী হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) কিছু সংখ্যক হাবশী মুসলমানদের নিয়ে সম্রাট নাজ্জাশীর দেয়া একটি জাহাজে করে পূর্ব দিকে সমুদ্র পথে বের হন। তাঁর নেতৃত্বে ৬১৬ খ্রি. ০৫ (পাঁচ) জন সাহাবী হযরত কায়স ইবনে ছায়ফুরী (রা.), হযরত উর ওয়াহ ইবনে আছাম (রা.), আবু কায়স ইবনে হারিস (রা.), হযরত তামিম আনসারী (রা) তাঁরা চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে সূদুর চীন গমন করেন। তাঁরা এই সময় দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে অবস্থান করেছিলেন।
হযরত আবি ওয়াক্কাস ইবনে মালিক ইবনে উহায়ব রা. সম্পর্কে ছিলেন রাসূল সা.এর মামা (মা আমিনার চাচাতো ভাই)। আবার তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ সাহাবি হযরত সা’দের রা. এর পিতা।হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ইসলামের ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠ সেনাপতি, প্রজ্ঞাশীল রাজনীতিবিদ ও গভর্নর হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। রাসূলে করীম (সা) এর জীবদ্দশায় যে কয়েকজন সাহাবী জান্নাতে যাওয়ার সুসংবাদ পেয়েছিলেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম।
৬২৬ খ্রিস্টাব্দ ইসলাম প্রচারকগণ চীনে অবতরণ করেন। তাদের নির্মিত কেয়াংটাং মসজিদ এবং মসজিদের অদূরেই হযরত আবি ওয়াক্কাসের কৃত্রিম কবর এখনাে চীনা মুসলামানদের জিয়ারতগার। হযরত আবি ওয়াক্কাসের এ কাফেলা হাবশা হতে চীন আসতে নয় বছর সময় নেয়। পথিমধ্যে অনেক দেশে জাহাজ নােঙ্গর করে। চট্টগ্রামও সেই তালিকা হতে বাদ পড়েনি। কারণ এটা জাহাজ চলাচলের জন্য নিরাপদ ট্টানজিট রুট।
পরবর্তীতে ৬১৭ খ্রি. পরে আমিরুল মুমেনীন হযরত ওমর (রা) এর সময় আরো একটি আরবদেশের ধর্মপ্রচারক দল চট্টগ্রামে আসেন।তাঁরা হলেন, হযরত মামুন (রা),হযরত মোহাইমিন (রা), হযরত আবু তালেব (রা), হযরত মরতুজা (রা), হযরত আব্দুল্লাহ (রা), হযরত হামিদ উদ্দীন (রা), হযরত হোসাইন (রা) প্রমুখ। তবে তাঁরা কতদিন চট্টগ্রামে ছিলেন জানা যায়নি।
মুসলিম জাহান পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাজা হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে (৬০৬-৬৪৩ খ্রিঃ) আরব দেশ হতে একটি ছােট্ট প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করতে আসেন। তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণে মুগ্ধ হয়ে এই অঞ্চলের অধিবাসীগণ ব্যাপকহারে ইসলাম গ্রহণ করেন। আল্লামা জয়নুদ্দীন তাঁর তুহফাতুল মুজাহেদীন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মুহাম্মদ (সা) এর যুগে চট্টগ্রামে ইসলাম আসে। হযরত শাহ জালাল (রহ.) সিলেট বিজয়ের সময় যে বুরহানুদ্দীন ছিলেন তিনি এই আরবদেরই বংশধর। প্রখ্যাত গবেষক ড. হাসান জামান রচিত ও বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ‘সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য’ গ্রন্থে রাসূল (সা) এর যুগে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের কথা নির্দ্বিধায় উল্লেখ করেছেন।
তথ্যসূত্র:
১।ইতিহাস ও মনীষী, সোহেল মো.ফখরুদ-দীন।
২।চট্টগ্রামে মুসলমান আগমনের ইতিকথা, সোহেল মো.ফখরুদ-দীন।
৩।তিরমিজি: আস সুনাম, কিতাবুল মানাকিব।
৪।বঙ্গদেশে মুসলমান ও পীর আউলিয়া-সূফী সাধকের চট্টগ্রাম, সোহেল মো.ফখরুদ-দীন।
লেখক:প্রচার ও প্রকাশনা সচিব, বাংলাদেশ মুসলমান ইতিহাস সমিতি।