আজ ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সাফাত বিন ছানাউল্লাহঃ যুগের প্রেক্ষাপটে এমন কতগুলো রত্মের জন্ম হয় পৃথিবীতে যাদের জ্ঞানের গভীরতায় চারদিকে আলো ছড়িয়ে পড়ে। নিজে নীরবে নিভৃতে থাকলেও জ্ঞানের প্রসারে প্রজন্ম আলোকিত হয়। তেমনি একজন মহান ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী মুফতি পরিবারের উজ্জ্বল নক্ষত্র, মৌলানা মঞ্জিলের রাহবার হযরত মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ শফিউর রহমান (রহঃ) সুযোগ্য নাতি, অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুর রহমান (রহঃ) এর পুত্র এবং প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ও বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন ঢাকা আলিয়ার মুহাদ্দিস ও সিলেট সরকারি আলিয়ার অধ্যক্ষ আল্লামা ফখরুদ্দীন (রহ) এর ভাতিজা ও বড় জামাতা অসাধারণ মেধাবী ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী,বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ,রিসার্চ স্কলার,লেখক, গবেষক বহু গ্রন্থ প্রণেতা উস্তাজুল আসাতেযা, ঐতিহ্যবাহী জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রী মাদ্রাসার সফল অধ্যক্ষ মুফতি আমিনুর রহমান আলকাদেরী (রহঃ)।
শিক্ষা জীবনে তিনি পিতা মাওলানা মাহমুদুর রহমান (রহ.) এর তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে দাখিল পরীক্ষায় ১ম বিভাগ ২য়, ১৯৭৯ সালে আলিম পরীক্ষায় ১ম বিভাগ ৩য়, ১৯৮১ সালে ফাজিল পরীক্ষায় ১ম বিভাগ ৫ম স্থান, ১৯৮৩ সালে মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকা হতে কামিল হাদীস পরীক্ষায় ১ম শ্রেণি ৩য় স্থান, ১৯৮৪ সালে মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা হতে কামিল ফিকহ পরীক্ষায় ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান, ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক বিভাগ হতে এমএ ১ম পর্ব ১ম বিভাগ ১ম স্থান, ১৯৯০ সালে এম.এ ফাইনাল পরীক্ষায় ১ম বিভাগ ২য় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।
বহুমুখী পাণ্ডিত্যের অধিকারী অধ্যক্ষ আল্লামা মুফতি আমিনুর রহমান (রহঃ) সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছে আমার। বেশ কয়েকটি মাহফিলে, সভায় বক্তব্য শুনেছি। বক্তব্যে বুঝা যেত কতটা জ্ঞানী ছিলেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী; ইলম, হেকমত ও আধ্যাত্মিকতার অপূর্ব সমন্বয় ছিল তাঁর বক্তৃতায়। তাঁর মুখনিসৃত বাণী যখন শ্রোতাদের কানে ধ্বণিত হত তারা হত আপ্লুত। ‘নিশ্চয় বয়ানে জাদু আছে’ হাদীসের বাস্তবরূপ ছিল তাঁর বক্তৃতা। বাবার চাচী, পাশের বাড়ির দাদির বোনের ছেলে উনি। সেই সুবাদে কয়েকবার এসেছিলেন। বিনয়ের সাথে কথা বলেছেন। এটা-ওটা জানতে চেয়েছেন। একসাথে নাস্তা করার সৌভাগ্য হয়েছে। নরম সুরে কথাগুলো এখনো কানে বাজে। মুফতি আমিনুর রহমান (রহ) এর স্নেহ ভালোবাসা কখনো ভুলবার নয়।
অসম্ভব খাঁটি একজন মানুষ। যাঁর গুণাবলি লিখে শেষ করা যাবেনা। আপনি একজন মুত্তাবিউস সুন্নাহ মানুষ দেখতে চান, নির্দিধায় তাঁকে দেখে নিতে পারেন। আলিমে রাব্বানী ও হক্কানির বাস্তব প্রতিচ্ছবি। এই মানুষটির সম্পর্কে আমি যা লিখব তা নিতান্তই অল্প হবে। নির্লোভ-নিরহংকার একজন সাদামাঠা মানুষ। মাটির মানুষ। সাধাসিধে আর অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই মহান সাধক। বিলাসিতা আর লৌকিকতা তাঁকে স্পর্শ করেছে বলে মনে হয় না।
ইখলাসের মধ্যে দিয়ে যাঁর পুরো জীবন অতিবাহিত হয়েছে। মুফতি আমিন সাহেব ছিলেন তাকওয়া-খোদাভীরুতার মূর্তপ্রতিক। কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন থাকা যাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গুণ। অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে মাদ্রাসা পরিচালনার পাশাপাশি তিনি গবেষণায় নিয়োজিত থাকতেন সারাদিন। দ্বীন ইসলামের একনিষ্ঠ ধারক ও বাহক হিসেবে অসংখ্য গবেষণাধর্মী কিতাব, ছোট পুস্তিকা তিনি রচনা করেছেন। মানুষের সঙ্গে নম্র-ভদ্রভাবে কথা বলা যাঁর জন্মগত স্বভাব। সুমহান চরিত্রের ভাস্বর। সরল প্রকৃতির একজন মানুষ। তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিরহংকার, সহজ -সরল, সাদাসিধে এক সাধক পুরুষ। বেশ ভুষায়ও অতি সাধারণ। আড়ম্বরপূর্ণ কোন কিছুই তার পছন্দ ছিলোনা। আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য অর্জন ও রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দর্শনে তিনি রাতকে রাত খুব পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু তা কখনোই প্রকাশ করেননি। প্রচারেও ব্যাপৃত হননি বাজারী পণ্যের মত। নিজেকে রেখেছেন অবগুন্ঠিত। মনীষীদের বাণী “যে ঝিনুকে মুক্তা ফলে গভীর জলে যায়গো চলে কিনার দিয়ে আর চলে না”
নবী প্রেমিক বলে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চুমু খেয়ে চোখে মাখিয়ে নিতেন। সেই নামের জ্যোর্তিময় আভায় তার চোখে জ্যোতি এসে যেত।তিনি সকলকে এ রূপ করার উপদেশ দিতেন। দুনিয়ার প্রতি তেমন টান ছিলনা। অন্তরে ছিল শুধু আল্লাহ ও রাসুলের মহব্বত। বিভিন্ন দরবার থেকে তিনি খেলাফত প্রাপ্ত হলেও এগুলো পুঁজি করে তিনি কখনই ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেননি। প্রিয় নবীর সুন্নত অনুযায়ী তিনি মেহমানদারীতে ছিলেন অদ্বিতীয় একজন। গত ৬ ডিসেম্বর ২০২২ আকস্মিকভাবে তিনি সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ইন্তেকাল করেন। পরেরদিন বাদ আসর দাদা হযরত মুফতি শফিউর রহমান (রহঃ) এর প্রতিষ্ঠিত জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রী মাদ্রাসা ময়দানে হাজার হাজার মুসল্লির উপস্থিতিতে নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। নামাজে জানাজায় জনপ্রতিনিধি, শত শত বরেণ্য আলেম সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের ঢল নামে। শতশত মানুষ নামাজে জানাযায় প্রিয়জন হারানোর ব্যথা নিয়ে ভাঙা হৃদয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে মাগফেরাত কামনা করে। মানুষ মৃত্যুবরণ করার পর আমল বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তিনটি আমলের ধারা উন্মুক্ত থাকে, সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম, নেককার সন্তান যারা তার জন্য দুআ করে প্রতিনিয়ত হযরত আল্লামা মুফতি আমিনুর রহমান (রহঃ) এসব রেখে গেছেন। মহান আল্লাহ দ্বীন ইসলাম ও সুন্নিয়তের একনিষ্ঠ এই খাদেমকে সুউচ্চ স্থান দান করুন আমিন।সাফাত বিন ছানাউল্লাহ্ কবি,প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী সাতবাড়ীয়া,চন্দনাইশ,চট্টগ্রাম