আজ ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন চন্দনাইশ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। এই উপজেলাটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাহাড়ী ও সমতল ভূমির সন্নিবেশে গঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। চন্দনাইশের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রবাহমান। এই চন্দনাইশ ছিল পটিয়া উপজেলার একটি অংশ। ১৯৭৬ সালে পটিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে চন্দনাইশ থানার সৃষ্টি করা হয়। ১৯৮৩ সালের ২ জুলাই চন্দনাইশ থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। কথিত আছে চন্দন ও আঁশ হতে চন্দনাইশ নামের উদ্ভব। এলাকাটি একসময় চন্দন গাছের উৎপাদন ও ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিলো। প্রাচীন জনপদ “চন্দনাইশ” নামের উৎপত্তি নিয়ে অধ্যাপক বদিউল আলম বলেন, চন্দন কাঠের নামানুসারে চন্দনাইশের নামকরণ করা হয়েছে। গবেষক পি. আর টমাস বলেছেন, প্রাচীন চিকন চাউল “চিনাইস” থেকে চন্দনাইশ নামের উৎপত্তি। তবে এ চন্দন অর্থ চন্দন কাঠ নয়। এটি একপ্রকার উপাদেয় সব্জি।এখানে চন্দন নামের সব্জির প্রাচুর্য ছিল। চন্দন সব্জির আঁইশ অত্যন্ত পুষ্টিকর ও বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক ছিল। এখান হতে বিভিন্ন এলাকায় চন্দন এর আঁইশ রাপ্তানি করা হতো। তাই এলাকাটির নাম হয় চন্দনাইশ।
চন্দনাইশের ঐতিহ্যবাহী মুফতি পরিবারের প্রধান কেন্দ্র বিন্দু মুফতি শফিউর রহমান (রহ) তার শিক্ষক মাওলানা নজীবুল্লাহ (রহ) কতৃক প্রতিষ্ঠিত চন্দনাইশে হাশিমপুর মকবুলিয়া সিনিয়ার মাদ্রাসাটি পুনঃ প্রতিষ্ঠা করে ১৯৩৯ সাল হতে ১৯৫৭ পর্যন্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। এবং পরবর্তীতে নিজ বাড়ীর পাশে জোয়ারা ইসলমিয়া ফাজিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ পদে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সহিত নিবিড়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। অবসর গ্রহণ করলেও ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত মাদরাসার বিভিন্ন কাজে অবদান রাখেন। এই দ্বীনি প্রতিষ্ঠান মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড,ঢাকা কতৃক ১৯৫৯ সালে দাখিল, ১৯৬১ সালে আলিম, ১৯৬৪ সালে ফাজিল এবং ১৯৮৩ সালে বিজ্ঞানের মঞ্জুরী লাভ করে। এরপরে ২০০৬ সালে মাদ্রাসাটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত হয়, এবং ২০১৬ সালে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্থানান্তরিত হয়। গরীব অসহায় ও এতীম ছাত্রদের জন্য লিল্লাহ বডিং নামে একটি এতিমখানা রয়েছে। উক্ত মাদরাসার প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে মুফতি সাহেবকে অনেক প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে হয়। তবুও তিনি হার মানেননি। কখনো কারো সাথে পরাজয়ের সুরে কথা বলেন নি। কারো কাছে কোনো আত্মসমর্পন করেননি। মাদরাসা পরিচালনার জন্যে তিনি কখনো কোন বিত্তশালীর কাছে বিনীত সূরে সাহায্য প্রার্থনা করেননি, বরং স্থানীয় জনগণ ও দুর-দুরান্তের ভক্তগণ তাঁর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজস্ব উদ্যোগে সাহায্য দেয়ার জন্য তাঁর কাছে আবেদন করেছে বারবার। এমনি কি মুফতি সাহেব মাদরাসার উন্নয়নে নিজের অর্থ ব্যয় করতে পিছপা হতেন না। এই মাদরাসার বর্তমান পরিচালনা কমিটির প্রায় সদস্য তাঁরই হাতে গড়া আদর্শ ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের মধ্যে মুফতি সাহেবের ব্যক্তিত্বের প্রভাব সুস্পষ্ট। তারা এখনো বিশ্বাস করেন মুফতি সাহেবের শুভ দৃষ্টি তাদের একমাত্র ক্রিয়াশক্তি।
উল্লেখ্য বার আউলিয়া স্মৃতি বিজড়িত চন্দনাইশ উপজেলার বিখ্যাত আলেম পরিবার ও জাতীয় ব্যক্তিত্বের জন্য “মুফতি পরিবার” সুপরিচিত।এই পরিবারের নামানুসারে পাড়ার নাম “মাওলানা মন্জিল” রাখা হয়। মুফতি সাহেবের ৯ ছেলে ৫ মেয়ে সবাই দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত।
জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসায় যারা পড়েছেন কুরআন হাদীসের দরস নিয়েছেন তাদের সংখ্যা এত বেশি যে তাদেরকে সংখ্যায়িত করা এখানে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে যে প্রতিষ্ঠানে খেদমত হচ্ছে, সেখানেই এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র আছে। বিভিন্ন মাদরাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ মুহাদ্দিস, প্রফেসর হিসেবে অনেক ছাত্রই আজ নিয়োজিত। এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদেরকে কুরআন-হাদীসের পাশাপাশি ধর্মীয় ও আরবী শিক্ষা দেয়া, ইসলামী আদর্শ ও চেতনা জাগ্রত করা, আদর্শবান ও চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলা, হানাফী মাযহাবের আলোকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত তথা সঠিক সুন্নী মতাদর্শ প্রচার প্রসার করাই ছিল দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছে সুন্নী মতাদর্শ ভিত্তিক ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিপুল সংখ্যক ইসলামী চিন্তাবিদ এবং ইসলামী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সহ আরো অনেক কর্মীবাহিনী। এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য শিষ্য বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়া দেশের বাইরেও অনেক ভাল ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত। দেশের প্রশাসনিক লোকদের মধ্যে অসংখ্য ছাত্র আছে।উল্লেখ্য জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার ছাত্ররা নানাভাবে ধর্মীয় ও সামজিক ও রাষ্ট্রীয় নানাক্ষেত্রে খেদমত আন্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। এটা একটি সফল ও আদর্শ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
মুফতি শফিউর রহমান (রহ) তাঁর প্রতিষ্ঠিত জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসরের পর থেকেই তারই বড় শাহাজাদা মাওলানা মাহমুদুর রহমান ২০০২ সাল পর্যন্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০২ সালে হতে আমৃত্যু পর্যন্ত মুফতি পরিবারের বড় নাতি বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক বহু গ্রন্থ প্রণেতা মুফতি আমিনুর রহমান অধ্যক্ষ পদে জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় সুনাম ও সুদক্ষ সহিত নিবিড়ভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উল্লেখ্য গত ০৬ ডিসেম্বর ২০২২ রাত ০৮.৩০ ঘটিকায় তিনি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ডাকে সাড়া দেন। অত্র মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক ও বাংলা বিভাগের প্রফেসর এস এম আজগর আলী গত ১১ ডিসেম্বর মঙ্গলবার হতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “তোমরা জাহেরি গোনাহও ছেড়ে দাও বাতেনি গোনাহও ছেড়ে দাও।”
জাহেরি গোনাহ তথা প্রকাশ্য গোনাহ হলো অঙ্গ-প্রতঙ্গের গোনাহ। আর বাতেনি গোনাহ হলো কলবের গোনাহ তথা অন্তরের গোনাহ। মানুষের অন্তরে হিংসা-হাসাদ-হিংসা, বুগয-শক্রতা, রিয়া-লৌকিকতা, কুফর ও শিরক রয়েছে এগুলো সব অন্তরের গোনাহ। আর প্রকাশ্য গোনাহ সম্পর্কীয় ইলমের নাম হলো ‘ইলমে শরীয়ত’ আর বাতেনি গোনাহ সম্পর্কীয় ইলমের নাম হলো ‘ইলমে তরীকত’।
হযরত ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি শরীয়তের ইলম অর্জন করলো, কিন্তু তরীকতের ইলম অর্জন করলো না, সে ফাসেক হলো। আর যে তরীকতের ইলম অর্জন করলো, কিন্তু শরিতের ইলম অর্জন করলো না, সে নাস্তিক হলো। আর যে ব্যক্তি উভয় ইলমকে একত্রে অর্জন করলো, সেই বাস্তব ইলম অর্জন করলো এবং সেই পরিপূর্ণ হলো।
জাহেরি গোনাহ ও বাতেনি গোনাহ থেকে বাঁচার কেন্দ্র হলো মাদরাসা। অর্থাৎ এখানে শরীয়তও আছে, তরীকতও আছে। এজন্য বলা হয়, তা’লীম ও তরবিয়ত, শিক্ষা ও দীক্ষা; উভয় জিনিসের নাম হলো মাদরাসা।চন্দনাইশের ঐতিহ্যবাহী মুফতি পরিবারের প্রধান কেন্দ্র বিন্দু মুফতি শফিউর রহমান (রহ) এর প্রতিষ্ঠিত জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসাও ব্যতিক্রম না। মুফতি সাহেব সব সময় ইলমে দ্বীনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা ভন্ডামী ও ধান্দাবাজ হওয়ার আশংকায় দরবার গড়ে তুলে তুলেননি। পরিবারের সদস্যদেরকে এই ব্যাপারে কড়া নিষেধ করেন। এমনকি তাঁর কবর পাকা করতেও। এলাকার প্রভাবশালী সমাজকর্মীরা এগিয়ে আসলে তাদেরকে না করে দেন। মুফতি সাহেব নিজ দরবার গড়ে না তুলে একটি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বার করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন সব সময় । মুফতি সাহেব কেবল জাহেবী জ্ঞান বিতরণ করে ক্লান্ত হননি,বরং তিনি আধ্যাত্মিক জগতের অন্যতম নক্ষত্র ছিলেন। তাঁর রূহানী ফুযুজাত এখনো জারী রয়েছে।তরিকতের ক্ষেত্রে তিনি শায়খুত তরীকত, যোবাদাতুল আসফিয়া, শাহিনশাহে সিরিকোট আল্লামা সৈয়দ আহমদ সিরিকোট (রহ) এর পবিত্র হস্তে সিলসিয়ায়ে আলিয়া কাদেরিয়ায় বায়াআত গ্রহণ করেন।
মুফতি সাহেবের ৩য় পুত্র শায়খুল হাদীস আল্লামা ফখরুদ্দীন (রহঃ) মুজাদ্দেদীয়া নকশবন্দীয়া তরীকতের উজ্জ্বল নক্ষত্র মুফতী সৈয়দ আমীমুল ইহছান মুজাদ্দেদী (রহঃ) এর পূণ্যময় হস্তে বায়আাত হন। মুফতী সাহেব তাঁকে স্বীয় লিখিত তাসাউফ বিষয়ক গ্রন্থ “আত্-তাশাররুফ লে আদাচিত তাসাউফ “ গ্রন্হটি প্রদান করেন এবং উক্ত গ্রন্থে বর্ণিত তরীকায়ে নকশবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া, তরীকায়ে মুজাদ্দেদীয়া কাদেরীয়া, মুজাদ্দেদীয়া চিশতীয়া,মুজাদ্দেদীয়া সোহরাওয়ার্দী তথা সূফী তরীকতের বিভিন্ন সনদগুলির ইযাযত দান করেন। প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ও বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন শায়খুল হাদীস আল্লামা ফখরুদ্দীন (রহ) এর হাতে তাঁর জামাতা, ভাতিজা ও শিষ্য অধ্যক্ষ মাওলানা আমিনুর রহমান (রহ) বায়াআত হন। একই সাথে সূফী তরীকতের বিভিন্ন সনদগুলির ইযাযত দানে ধন্য হন। এলাকায় অনেকেই শরীয়ত ও তরীকত নামে ভন্ডামী ও ধান্দাবাজ বেড়ে গেলে আল্লামা ফখরুদ্দীন (রহ) এর নির্দেশনায় ও পরামর্শে তাঁর জামাতা ও শিষ্য অধ্যক্ষ মাওলানা আমিনুর রহমান জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসায় তরীকতের চর্চা পুনরায় শুরু করেন। আল্লামা ফখরুদ্দীন (রহ) সব সময় বলতেন, “বে-ইলম কর্মী ও বে-আমল আলিম দ্বারা সুন্নিয়তের কোন উপকার হবেনা।” তরীকত চর্চার মাধ্যমে মাওলানা আমিনুর রহমান একজন আলা হযরত গবেষক,রেযা প্রেমিক, রেজভী সাহিত্যচর্চার একনিষ্ঠ সেবক, কাদেরিয়া রেজভীয়া তরিকতের বিশিষ্ট খাদেম হিসেবে মাযহাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের প্রচার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চুনতীর ঐতিহাসিক ১৯ দিন ব্যাপী মাহফিলে সীরাতুন্নবী (সা) এর প্রতিষ্ঠাতা হযরত শাহ হাফেজ আহমদ (রহ), বায়তুশ শরফ দরবারের পীর সাহেব বাহরুল উলুম আল্লামা কুতুবউদ্দিন শাহ (রহ), হাশেমী দরবারের আল্লামা সৈয়দ নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ), মুফতি ইদ্রিস রেজভী (রহ), গারাঙ্গিয়া দরবারের আল্লামা আব্দুল মজিদ (রহ) এবং হযরাতুল আল্লামা আব্দুন নূর সিদ্দিকী (রহ) সহ অনেক তরীকতের খাদেম আগমন করেন।
একটি চমকপ্রদ তথ্য হলো, মুফতি শফিউর রহমান (রহ) এর প্রতিষ্ঠিত জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাকালে প্রত্যক্ষভাবে ও পরোক্ষভাবে বিরোধীদের সন্তান ও নাতি-নাতনীগণ এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দ্বীনি শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েছেন। এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জ্ঞান বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসার এবং আধ্যাত্মিক অমীয় সুধা ধারা যুগ যুগ ধরে বহমান থাকুক।
লেখক : কলামিস্ট।
সদস্য, চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র।
প্রচার ও প্রকাশনা সচিব, বাংলাদেশ মুসলমান ইতিহাস সমিতি।