বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল -|- ১৬ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
hridoyechattogram.com - news@hridoyechattogram.com - www.facebook.com/hridoyechattogram/

জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা: যে দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে আমি ঋণী

প্রকাশিত হয়েছে- মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

 

মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ মাদ্রাসা শব্দটি আরবি। অর্থ পাঠদানের স্থান। ভারতীয় উপমহাদেশে মাদ্রাসা বলতে বুঝায়, যেখানে দ্বীনি জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয়। ( অর্থাৎ, কোরআন, হাদিস, বালাগাত,মানতিক, ছরফ, নাহু, ফাসাহাত, উসুল, আরবি সাহিত্য) ইত্যাদি। কালের আবর্তন ও বিবর্তনে মাদ্রাসা শিক্ষার সিলেবাস পরিবর্তন হয়েছে। এই রকম একটা সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান হলো দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায় অবস্থিত জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা। যা মহান আল্লাহ তায়ালার মকবুল অলি হযরত মাওলানা মুফতি শফিউর রহমান ( রহঃ) প্রকাশ (মুফতি সাহেব) ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। এই ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পিছনে এলাকাবাসীর যথেষ্ট অবদান ছিল। যা অকপটে স্বীকার করতে হয়। এদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে আমারা এই ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছি। মাওলানা মুফতি শফিউর রহমান ( রহঃ) কারো কাছে কোন বিষয় চেয়ে নিতেন না। একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি পূর্ণ তাওয়াক্কুল রাখতেন। তিনি দোয়াতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই প্রতিদিন যোহর ও মাগরিবের নামাজের পরে ” দাওয়াতে খাচ” নামক একটা দাওয়াতের প্রবর্তন করেছিলেন। এই দাওয়াতে বদৌলতে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা সব সমস্যা সমাধান করে দিতেন। সব প্রয়োজন মিটিয়ে দিতেন।

তৎকালীন মাদ্রাসার গরীব, এতিম,ছাত্রদের জন্য ফ্রী থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। মাদ্রাসার সামনে ও পিছনের মাঠে ক্ষেত করা হতো। যার মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান/ একজন ছাত্র আত্মনির্ভারশীল হওয়ার উৎসাহ পায়। মাদ্রাসার হোস্টেলে ৪৫- ৫০ জন ছাত্র ছিল। সাতকানিয়া, লোহাগড়া, চকরিয়া, বাঁশখালী,পেকুয়া, কক্সবাজারসহ প্রভৃতি এলাকার। হোস্টেলে জায়গার সংকুলান না হওয়াতে অনেক কে লজিং এর ব্যবস্থা করে দেওয়া হতো।
মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন মুফতি মাওলানা শফিউর রহমান (রহঃ), ওনার পর অধ্যক্ষ হলেন, তার জ্যোষ্ঠপুত্র অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুর রহমান (রহঃ) ২০০২ পর্যন্ত। ২০০২ সাল থেকে ২০২২সালে ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত অধ্যক্ষ পদের দায়িত্ব পালন করছিল মাওলানা মঞ্জিলের সুযোগ্য নাতি বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক, ইসলামিক স্কলার, আমার অত্যন্ত প্রিয় অধ্যক্ষ মাওলানা আমিনুর রহমান (রহঃ)। ওনার হাত ধরে এগিয়ে গিয়েছে ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার সার্বিক উন্নয়নের কাজ ও সুনাম।
অধ্যক্ষ মাওলানা আমিনুর রহমান এর ইন্তেকালের পর (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন অধ্যাপক এস এম এর আজগর আলী স্যার। মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে স্যারের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। যেনো সঠিক ও সুন্দরভাবে কাজ আঞ্জাম দিতে পারেন।
এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হতে পারা আমার মতো নগন্যের জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। আমি ২০১০ সালের জুন মাসে এই মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ২০২২সাল পর্যন্ত ফাজিল অধ্যায়ন শেষ করি। আমার গ্রামের বাড়ি বাঁশখালী হলেও জীবনের অধিকাংশ সময় এখানে অতিবাহিত করি। এখানে আমার অসংখ্য বন্ধু- বান্ধব, শিক্ষক, শিক্ষিকা, শুভাকাঙ্ক্ষী রয়েছে। সবাই আমাকে পরম আদর স্নেহ করতেন। এই আদরের কোন ইতি নেই। ২০১০ সালের ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষায় ১ম বিভাগ উত্তীর্ণ হই। ২০১৩ সালে জে ডি সি পরীক্ষায় এ প্লাস অর্জন করি। ২০১৬ সালে দাখিল, ২০১৮ সালে আলিম ২০২২ সালে ফাজিল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সহিত পাশ করি।
আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তাম। তখন প্রতি অধ্যায় শেষ হলে পরীক্ষা নেওয়া হতো। যে শিক্ষক যে বিষয়ে পাঠদান করতো, তিনি সেই বিষয়ের পরীক্ষা নিয়ে খাতাগুলো আবার দিয়ে দিতো। সাথে যুক্ত থাকতো এক প্রাপ্ত নম্বর। এতে আমরা অনুপ্রেরণিত হয়ে। আরও লেখা পড়ায় মনোযোগী হতাম।
২০১৩ সালে অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন মরহুম মাস্টার হাবিবুর রহমান এর কাছে ১২০ টাকা দিয়ে গণিত ও ইংরেজি প্রাইভেট পড়তাম। আমরা যারা হোস্টেলে থাকতাম। আমাদের সুবিধার জন্য সপ্তাহ ভিত্তিক টাকা ভাগ করে স্যারকে দিয়ে দিতাম। তিনি খুবই ভালো গণিত কষতে পারতেন। কারো প্রাইভেট এর টাকা দিতে সমস্যা হলে, তিনি চাপ প্রয়োগ করতেন না।তিনি আমাকে খুবই ভালোবাসতেন।পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। আমি নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন লজিং থাকতাম। তাতে স্যারেরও একমত ছিল। ওনি আরও বলতো ছেলেদের পাঠাদানে কোন সমস্যা হলে।ওনার কাছ থেকে বুঝিয়ে নিতে। কারণ ওনি শিক্ষার্থীদের অভাব অভিযোগ খুব মনোযোগসহ শ্রবণ করতেন।এবং গঠনমূলক পরামর্শ দিতেন। ওনি নিজেও দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। প্রিয় স্যার মাস্টার হাবিবুর রহমান স্যারও ৩রা রমজান ২০২২ মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান।মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে স্যারের মাগফিরাত কামনা করছি।
২০১৫ সালের অগাস্ট মাসের ১৭/১৮ তারিখের দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশিত ছাত্র কেবিনেট নির্বাচন হয়েছিল। আমি দশম শ্রেণির ক্যাপ্টেন হিসেবে নির্বাচন করি। ওই নির্বাচন ছিল খুবই আনন্দপূর্ণ।আমরা প্রার্থী ছিলাম তিনজন। মোহাম্মদ আবদুল আলীম রজভী,মোহাম্মদ ফয়সাল উদদীন ও আমি।মাস্টার মাহফুজুর রহমান এর পরিচালনায় সহকারী শিক্ষক মাওলানা আব্দুল মাজেদ ও শ্রেণি শিক্ষক শাহেদা বেগম এর উপস্থিতিতে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমি সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে “ক্যাবিনেট ” নির্বাচন হয়েছিলাম। ওই সময় নির্বাচিত হয়ে আমি আমার ক্লাসের সবাইকে মিষ্টান্ন হিসেবে চকলেট দিয়ে ছিলাম সামর্থ্য অনুযায়ী।এইসব স্মৃতি এখনো মনে পড়ে।

আমি গুনাহগার অধিক সময় অধ্যক্ষ মাওলানা আমিনুর রহমান (রহঃ) এর সাথে কাটিয়েছি। হুজুর আমার জন্য প্রায় সময় খাচ করে দোয়া করতেন। আমি হুজুরের নিকট তাফসীর ও হাদীস পড়ার সৌভাগ্য অর্জন হয়েছিলো। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা ওবাইদুল করিম (অবঃ), মাওলানা মামুনুল হক,মাওলানা আমজাদ , মাওলানা সিরাজুল হক (অবঃ), জীব বিজ্ঞানের শিক্ষক মুহাম্মদ মুসা ( বর্তমানে তিনি সীতাকুণ্ড ডিগ্রি কলেজ এর উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োজিত আছেন।) মাদরাসার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এস এম আজগর আলী সহ আরো অনেকের কাছে পড়ার সুযোগ হয়েছে।
এই ঐতিহ্যবাহী জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করে অনেক সাফল্য উচ্চ শিখরে আরোহন করেছেন। এই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রেজাল্ট যা একসময় পুরো দেশকে চমক দেখিয়ে দিয়েছিল। মরহুম মাস্টার হাবিবুর রহমান এর অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে ছাত্ররা স্কাউট’ এর সর্বোচ্চ পদক “প্রসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড ” অর্জন করেছিল। উক্ত মাদ্রাসা জাতিকে উপহার দিয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, ডিসি, এসপি,ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ওসি, এসআই ও ব্যাংকার ও সমাজসেবক সহ অসংখ্য কৃতি ব্যক্তিত্ব।
মহান আল্লাহ তায়ালা যেন এই প্রিয় প্রতিষ্ঠান কে দ্বীনের মারকজ হিসেবে কবুল করুক। একইসাথে মাদ্রাসার কল্যাণ কামনা করছি।

 

লেখক: প্রাক্তন ছাত্র, জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা।