বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল -|- ১৬ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
hridoyechattogram.com - news@hridoyechattogram.com - www.facebook.com/hridoyechattogram/

লামায় নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে কাজ করছেন নারীনেত্রী ফাতেমা পারুল

প্রকাশিত হয়েছে- বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৯

মোঃ সেলিম উদ্দীন,বিশেষ প্রতিনিধি প্রতিনিধি:
বান্দরবানের লামায় নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে কাজ করছেন নারীনেত্রী ও বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য ফাতেমা পারুল। নারীদের ভাগ্যোন্নয়নে ‘নব জাগরণ মহিলা উন্নয়ন সমিতি’ মাধ্যমে অসহায়, দরিদ্র, স্বামী পরিত্যক্ত, বিধবা, অস্বচ্ছল পরিবারের নারীদের স্বপ্নও দেখান তিনি। আবার এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলস কাজও করছেন এ নারী উদ্যোক্তা। ‘সেলাই কাজ, পুতির তৈরি টিস্যু বক্স, নকশি কাঁথা, ব্লক-বাটিক, বাঁশ-বেত ও বিভিন্ন ফুলের টপ তৈরি’ নারীর ভাগ্য বদলের হাতিয়ার তার। ফাতেমার এ মহতি উদ্যোগে এখন সমিতির সদস্যরা কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পেয়েছে। অনেকে এই আয় দিয়ে সংসার চালাচ্ছে।

ফাতেমা পারুল ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারী বান্দরবানের লামা পৌরসভার চাম্পাতলী গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক ও মা আনোয়ারা বেগম। এক ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ১৯৯০ সালে লামা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা পাশের পর আর পড়ালেখা করার সৌভাগ্য হয়নি ফাতেমা পারুলের। ২০ বছর বয়সে পশ্চিম রাজবাড়ী আবদুল আজিজের সঙ্গে তাকে বিয়ে দেন মা-বাবা। বর্তমানে স্বামী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বর্তমানে তিনি বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের একজন সদস্য। রাজনৈতিক জীবনে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের লামা উপজেলা সভানেত্রী। ২০১৭ সালে অর্থনৈতিকভাবে সফল নারী হওয়ায় উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতর তাকে ‘জয়িতা’ সম্মাননা প্রদান করে।

সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে আশপাশের অবহেলিত দরিদ্র নারীদের নিয়ে কিছু একটা করার কথা ভাবতেন ফাতেমা। তখন থেকে বিভিন্নভাবে অসহায় নারীদের সহায়তাও করতেন তিনি। এক পর্যায়ে ২০০১ সালে লামা পৌরসভার প্রথম নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হন ফাতেমা। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর অবহেলিত নারীদের উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ আরো প্রসারিত হয়। তিনি অবহেলিত দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নব জাগরণ মহিলা উন্নয়ন সমিতি’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। মাত্র ১৫ জন নারী নিয়ে শুরু করেন সংগঠনের কার্যক্রম। বর্তমানে দেড় শতাধিক নারী এ সংগঠনের সদস্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নব জাগরণ মহিলা উন্নয়ন সমিতির উদ্যোগে বাল্য বিবাহ রোধ, নারী নির্যাতন, যৌতুক প্রথা, শিশু পাচার রোধে সচেতনতামূলক সভা সেমিনারসহ জাতীয় দিবসের মধ্যে নারী দিবসসহ বিভিন্ন দিবস পালন করে আসছে যথাযথভাবে। এছাড়া এলাকার অবহেলিত দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে এই সমিতি বেশ কয়েক ধাপে দু শতাধিক বেকার নারীকে সেলাইসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়। তাদের মধ্যে কিছু নারী সেলাই, আর কিছু পুতির তৈরি টিস্যু বক্স, নকশি কাঁথা, ব্লক-বাটিক, বাঁশ-বেত ও বিভিন্ন ফুলের টপ তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে এ কাজ করে এখন সংসার চালায়। স্বামীর পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের পড়া লেখার খরচও যোগান দেন প্রশিক্ষিত এ নারীরা।

লামা পৌর এলাকার কলিঙ্গাবিলের কামাল উদ্দিনের স্ত্রী মুক্তা বেগম, কাটা পাহাড়ের মোশারফের স্ত্রী রোকসানা বেগম, চরোয়া বিলের রাশেদা বেগম, পশ্চিম রাজবাড়ীর শাহেনা বেগম, নুরজাহান বেগম, আনোয়ারা বেগম ও মধুঝিরি গ্রামের লায়লা বেগম উল্লেখযোগ্য। এ সমিতির মাধ্যমে গত দেড় বছরে প্রতি ব্যাচে ৩৫জন করে ১৭৫ জন নারী এ সমিতির উদ্যোগে নকশি কাঁথা, সেলাইসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বর্তমানেও নারীদের কারিগরিভাবে দক্ষ করে তুলতে পাপস বুনন, অ্যামব্রয়ডারি, বাটিক, বুটিকসহ মোট নয়টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।

ফাতেমার অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধার সমন্বয়ে ২০০০ সালে সমিতিটি মহিলা বিষয়ক ও যুব উন্নয়ন অধিদফতর কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন লাভ করে আরো একধাপ এগিয়ে যায়। শুরুতে বাঁশের বেড়া ও ছনের ছাউনির ঘর দিয়ে সমিতির কার্যক্রম শুরু করা হয়। বহু আবেদনের পর ২০১২-১৩ অর্থ বছরে সরকারিভাবে এডিবির অর্থায়নে একটি টিনের ছাউনি ও টিনের বেড়া ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়। তবে সমিতির ঘর থাকলেও নেই পর্যাপ্ত আসবাবপত্র ও প্রশিক্ষণের সরঞ্জমাদি। আসবাবপত্র না থাকায় যেমন সমিতির দৈনন্দিন কাজে দারুন ব্যাঘাত ঘটছে, তেমনি প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী এলাকার অবহেলিত বেকার নারীদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা সম্ভব হয় না।

সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বেঞ্চে বসে ৩৫-৩৫ জন নারী। পেশায় তারা গৃহবধূ। আর সমিতির সভানেত্রী ফাতেমা তাদেরকে বাল্য বিবাহ রোধ, নারী পাচার রোধ, নারী নির্যাতন ও যৌতুক প্রথা রোধসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর সচেতনতা বিষয়ক ধারণা দিচ্ছেন। এ সময় প্রশিক্ষণার্থী নুরজাহান বেগম, আনোয়ারা বেগম ও লায়লা বেগম বলেন, তাদের স্বামী মানুষের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে। তার আয় দিয়ে সন্তানের লেখাপড়া ও সংসার চলে না। ফাতেমা পারুলের সহযোগিতায় আমরা নকশিকাঁথা, ব্লক-বাটিক ও সেলাইয়ের কাজ করছি। আমাদের তৈরি জিনিসপত্র এখন সবার নজর কেড়েছে। এখান থেকে আমরা প্রতিমাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা করে আয় করি।

সমিতির সভানেত্রী ফাতেমা বলেন, অবহেলিত অসহায় নারীদের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানসহ ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা করছি। আবার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের উৎপাদিত পণ্যসমূহ যেন সঠিক দামে ও ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারে সেজন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সাথে সমন্বয় করছি। তিনি আরো বলেন, বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ, ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে এসকল অসহায় নারীদের এগিয়ে নিতে হবে। সেজন্যে পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারায় কৃজ্ঞতা জানাই।

এ বিষয়ে লামা উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসার (অতিরিক্ত দা:) আতিয়া চৌধুরী বলেন, দেশকে উন্নত করতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও আয় বৃদ্ধিমূলক কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলে প্রতিটি পরিবারে অর্থের সংকট দূর হওয়ার পাশাপাশি পরিবার তথা সমাজ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।