বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -|- ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল -|- ১৬ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
hridoyechattogram.com - news@hridoyechattogram.com - www.facebook.com/hridoyechattogram/

পাহাড়ের রাজনীতিতে ঐক্য অনৈক্য ও ষড়যন্ত্র!

প্রকাশিত হয়েছে- বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯

 

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সমতল হতে ভিন্ন এতে কোন সন্দেহ নেই। ভৌগোলিক অবস্থান ও কৌশলগত কারণে এতোদাঞ্চলের রাজনীতি অন্তর্জাতিক রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। অন্তর্জাতিক আগ্রাসনবাদীদের সৃষ্টি এই অঞ্চলে বহুযুগ ধরেই নিবদ্ধ রয়েছে। আর এসব কারণেই আমেরিকান ব্লক ও চিনা ব্লকের সহযোগিতায় বেশ কিছু বামপন্থী ও চরমপন্থী দল এখানে সক্রিয়। বরাবরের মতো আঞ্চলিক সংগঠন গুলোর আধিপত্য লক্ষ করা যায় এখানে।
উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মূলত বিভিন্ন বৈষম্য ও প্রবঞ্চনা নিয়ে এই সংগঠন গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাতিগত বিদ্বেষ এখানে চরমভাবে পরিলক্ষিত হয়। উপজাতি জনগোষ্ঠীকে সামগ্রিক ভাবে বিচার করতে গেলে দেখা যায় মোট তেরো হতে চৌদ্দটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী মিলে একটি বৃহৎ উপজাতি জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তবে তাদের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও খাদ্যাভাস ভিন্ন ভিন্ন। অার এসব কারণে তাদের মধ্যে প্রায়শই অান্তঃগোষ্ঠিয় বিবাদ লক্ষ্য করা যায়।
তবে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বাঙালি অধিবাসী লোকেরা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে ভিন্ন হলেও একই ধর্ম ও সংস্কৃতির চর্চা করে ফলে তারা সামগ্রিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ।
উপনিবেশ কালে বৃটিশ সরকার নিজেদের শাসনতান্ত্রিক সুবিধা ও সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারার ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আইন প্রনয়ণ করে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি প্রণিত হয় যা পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি বিশেষ অঞ্চলের মর্যাদা দেয়। পরবর্তী কালে এই অাইন পরিমার্জিত হয়ে ১৯৮৯ সালের পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তি সহ ভিন্ন ভিন্ন সুবিধা সহ উপজাতি জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বহু বিধি প্রনয়ন করা হয়। আর এসব আইন ও বিধি সরাসরি ভাবে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে বলে প্রতিভাত হয়।
সংখ্যালঘু উপজাতি জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতধারার সাথে সমান তালে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পদ সংরক্ষণের নানা ব্যবস্থা অনেকটা বৈষম্য মূলক বলে প্রতীয়মান হতে থাকে।
আর এসব কারণে বঞ্চিত বাঙালী জনগোষ্ঠীর পক্ষে বেশ কিছু সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিক ভাবে নিজেদের অধিকার অাদায়ে মাঠে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বিগত পাঁচ বছরে মাঠ পর্যায়ে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে এই আন্দোলন কর্মসূচিতে সবচাইতে বেশী সক্রিয় ছিলো জনাব মাইন উদ্দিন এর প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য অধিকার ফোরাম, সাবেক সাংসদ ওয়াদুদ ভূইঁয়ার সম-অধিকার আন্দোলন এডভোকেট ইয়াকুব আলী চৌধুরী ও আলকাছ মামুনের বাঙালি ছাত্র পরিষদ ও নাগরিক পরিষদ। এছাড়াও সংগ্রাম পরিষদ সহ একাধিক বাঙালি সংগঠনকে মাঠ পর্যায়ে কর্মসূচি পালন করতে দেখা গিয়েছে।
পাশাপাশি এই সংগঠন গুলোতে নের্তৃত্বের দ্বন্দ্ব ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য হতেও দেখা গিয়েছে বেশ কয়েকবার। বিশেষ করে আলকাছ আল মামুনের বাঙালি ছাত্র পরিষদে জামাত শিবিরের বেশ কজন রোকন ও নেতা জড়িত থাকায় সাংগঠনিক বিভাজন তৈরি হয়।
শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কেউ বিএনপির নির্বাচন কেউ জাতীয় পার্টির নির্বাচন করা নিয়েও দলে টান পোড়ন ও বিভেদ সৃষ্টি হয়।
এসব বিভাজনের পরও পার্বত্য অধিকার ফোরাম, সচেতন পার্বত্যবাসী সহ আরো বেশ কয়েকটি সংগঠন মাঠে জোড়ালো কর্মসূচি পালনে সচেষ্ট থাকে।
বেশকিছু দিন ধরে লক্ষ্য করছি পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল বাঙালী সংগঠন গুলো কে বিলুপ্ত করে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করা হবে।
সকলে এক প্লাটফর্মে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শামিল হবে এটা বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত সুখকর একটা বিষয় কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কারা এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে চান অথবা তাদের রাজনৈতিক ইতিহাস কি এটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাড়িঁয়েছে। যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলনের সফলতা ব্যর্থতা অননুমেয় তাই সকল সংগঠন বিলুপ্ত ঘোষণা করে নতুন সংগ্রঠন করা বা পুরোনো কোন সংগঠনের সাথে একীভূত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বিনষ্ট করে দেওয়ার পক্ষে বাঙালি সংগঠন গুলোর কর্ণধার বা প্রতিষ্ঠাতের মতই বা কি তা জানা আবশ্যক। এবিষয়ে পার্বত্য অধিকার ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাইন উদ্দিন এর ভাষ্য আমি ব্যক্তি বিশেষ কেউ নই সাংগঠনিক লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য অনুযায়ী আমি কাজ করি। ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে আমি বা আমার সংগঠনের কোন দ্বিমত নেই। তবে সংগঠনের অস্তিত্ব বিলোপের ব্যাপারে কোন সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। সম-অধিকারের প্রতিষ্ঠাতা জনাব ওয়াদুদ ভূঁইয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

বর্তমানে পূর্বের একটি সংগঠন নাগরিক পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনরত সকল বাঙালী সংগঠনকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে ঐক্য ঘোষণা করেছে। কোন সংগঠন বিলুপ্ত ঘোষণা করার এখতিয়ার কেবল সংগঠন প্রতিষ্ঠা কারীরই থাকার কথা। অন্য কেউ সংগঠন বিলুপ্ত করার অধিকার রাখে না।
এবিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক সুধিজনের পাশাপাশি আমি নিজেও উদ্বেগ প্রকাশ করছি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের স্বার্থে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন জরুরি কিন্তু সকল সংগঠন বিলুপ্ত করার বিষয়টি অত্যন্ত মারাত্মক ও আত্মঘাতী।
এটা ভাবা অমূলক নয় যে সকল সংগঠনকে গুঁড়িয়ে দিয়ে একটি সংগঠন করা হলে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে যে কোন অপশক্তি ও ষড়যন্ত্র কারীদের জন্য।
বাঙালি জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে পেছন থেকে কোন শক্তি যদি নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য পরিচালিত করে এটা পার্বত্য বাঙালিদের জন্য অশনিসংকেত। এটা সকল বাঙালী সংগঠনকে ধ্বংস করার একটা গভীর ষড়যন্ত্র কিনা সে বিষয়ে সকলকে সচেতন থাকতে হবে।
তাই এই অঞ্চলে আন্দোলনরত সকল বাঙালী সংগঠন ও সচেতন নাগরিকদের ভাবতে হবে এই ঐক্য প্রক্রিয়ার সফলতা ব্যর্থতা ও সম্ভাবনা এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণে অত্যন্ত কৌশলী হওয়ার বিকল্প নাই।

লেখক
আহাম্মদ রিদোয়ান
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক লেখক ও গবেষক।