শুক্রবার, ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ -|- ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শীতকাল -|- ১লা শাবান, ১৪৪৬ হিজরি
hridoyechattogram.com - news@hridoyechattogram.com - www.facebook.com/hridoyechattogram/

বসন্তবাবুর মিনু 

প্রকাশিত হয়েছে- সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯

 

লেখিকা: তুলোশী চক্রবর্তী

মেয়ে জামাই এর চাহিদা পুরন করতে গিয়ে শেষমেশ বাড়িটাও বিক্রী করে দিলেন বসন্তবাবু।
বুড়ো হয়েছেন কাজ করতে আর পারেন না , এখন যাবেন ই বা কোথায় আর খাবেন ই বা কি।রেলস্টেশনে বসে এইসব ভাবতে ভাবতে দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেলো, সারাদিন আজ কিছু খান নি, কোনো একসময় অঢেল সম্পত্তির মালিক বসন্তবাবুর আজ ভালো খাবার কেনার টাকাটাও নেই পকেটে। সাত পাঁচ ভেবে একটি পাউরুটি কিনলেন, আর না খেয়ে হাতে রুটি টি নিয়ে বসে রইলেন। হঠাৎ নোংরা ময়লা জামার একটা পাগলি রুটিটি কেড়ে নিয়ে দৌড় দিল। বসন্তবাবুর গা হিম হয়ে আসছে দাড়ানোর শক্তি ও নেই। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, তাই তিনি চুপ করেই বসে রইলেন। পুর্নিমা রাত সব কিছুই পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। পাগলি মেয়েটি একটু ছুটে থেমে গেল, কারন তাকে কেউ পিছু ধাওয়া করছে না, আর পিছন ফিরে তাকাল এবং একাকী বসে থাকা লোকটিকে চিনতে পারলো।

মিনিট দু এক পরে হঠাৎ কে যেনো বসন্তবাবুর পায়ে জড়িয়ে ধরলো, তিনি চেয়ে দেখলেন সেই ময়লা জামা পরিহিতা মেয়েটি পাউরুটি তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। আর ইশারায় ইঙ্গিতে অনেক কিছু বলছে। বসন্তবাবুর তখন বুঝতে দেরি হলো না যে সেই মেয়েটি কে? তখন তিনিও মেয়েটির হাত দুটি ধরে কাঁদতে লাগলেন।

সাতাশ বছর আগে বসন্তবাবু- প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার কয়েক মাস পরেই দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন।
উনার দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। একটি মেয়ে প্রথম স্ত্রীর। মেয়েটির নাম মিনু সেই হল এই ময়লা জামার মেয়েটি, সে জন্ম থেকেই বোবা আর কালা, তিন বছর বয়স থেকে সৎমার অত্যাচার সহ্য করতে করতে একসময় নিখোঁজ হয়ে যায় মেয়েটি, আজ ত্রিশ বছর পরে বাবার সঙ্গে মেয়ের দেখা। গত বছর মিনুর সৎমা বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।মিনুর বড় সৎ ভাই মাস্টার, সে বউ কে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকে, সেখানে তার বাবা কে যেতে বারণ করেছে। মিনুর সৎ ছোট ভাই পুলিশ অফিসার সে ও কর্মসুত্রে বাইরে থাকে। সৎ দিদির বিয়ে হয়ে গেছে পাঁচ বছর আগে ,বিয়েতে তার বাবা অনেক দামি গাড়ি উপহার দিয়েছে।
তবে মিনু এইসব নিয়ে ভাবে না কোনদিন, মিনু শুধু একটু মানুষের মতো বাঁচতে চেয়েছিল, বাবার আদর থেকে বঞ্চিত, সব ভাই বোনেরা শিক্ষিত হলেও সে লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত, নিজের পরিবারে যখন ভালোবাসা পায়নি তাকে সমাজ যে কেমন চোখে দেখবে তা সে জানে। কখনো একটু খাবারের জন্য সে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে। ঠান্ডায় ছেড়া জামা পরে ফুটপাতে রাত কাটিয়েছে। এতো কষ্ট সহ্য করেছে যা সে শুধু নিজেই জানে।
তবে দীর্ঘ্য ত্রিশ বছর পেরিয়ে আজ একটু বেশিই আনন্দ পাচ্ছে সে।কারন তার পিতা বসন্তবাবুর স্নেহ তার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে।
বোবা কালা মেয়ে বলে কেউ মানুষ হিসেবে গন্য করেনি , যে মিনু স্নেহ মায়া মমতা কখনো পায়নি আজ সে ই সহায় সম্বলহীন পিতার মুখে একটু খাবার তুলে দিতে চেষ্টা করে। বনের লতাপাতা দিয়ে একটি কুড়েঘর বানিয়েছে, সেখানে তার বাবা কে রাখে, দিনের বেলা সে ঘুরে ঘুরে খাবার জোগার করে, যা পায় আগে বাবাকে খাইয়ে পরে সে খায়।বৃদ্ধ বয়সে বসন্তবাবু আজ মেয়ে মিনুর কাছে হাত জোড় করে ক্ষমাপ্রার্থী। সারাজীবনভর যাদের জন্য নিজের সব দিয়েদিলো তারা আর ফিরেই চাইলো না শেষকালে। তার পাগলি মেয়েটাই আজ দেবীরুপে কাছে এলো। ছোট মেয়ের এ.সি রুমের চেয়েও শতগুন বেশি শান্তি পাচ্ছেন তিনি আজ এই লতাপাতার মাঝে। তিনি ভাবছেন তার যেনো নবজন্ম হলো।সদ্যোজাত শিশু ভুমিষ্ঠ হবার পরে মায়ের কাছে যেমন স্নেহ ভালোবাসা, যত্ন পায় ঠিক তেমন টাই যেন পাচ্ছেন তার পাগলি মেয়ের কাছে।বসন্তবাবুর মিনু ছাড়া বসন্তবাবু’কে দেখার মতো আর কেউ রইলো না।