তানভীর আহমেদ সিদ্দীকি:
[লেখাটি সম্পূর্ণ আমার জীবন থেকে নেয়া। আমার মায়ের সবটুকু আবেগ, ত্যাগ, ভালবাসা এ লেখায় আনার চেষ্টা করেছি। অন্তত আমাকে যারা এতটুকু ভালবাসেন তারা হলেও লেখাটি পড়ে দেখবেন।]
পৃথিবীর সমস্ত আবেগ যে অক্ষরে বন্দী তা হল ‘মা’। জীবনে এই শব্দের এত ব্যাপ্তি যে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করার মত যথেষ্ট শব্দ আমার নেই। মানুষের অনুভূতি, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা, আদর, শাষণ, কোমলতা মুগ্ধতা, প্রেরণা কেবল এই একটি শব্দে। পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম শব্দটির নাম মা। মা, আমাদের সেই গাছের ছায়া যেখানে জীবনের কঠোর তপ্ত রোদের মধ্যে এক ফালি ছায়া। ছয় বছর বয়সে আমার ক্লাস ওয়ানে ভর্তির প্রস্তুতি শুরু হয়। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা যাত্রা শুরু আমার এখান থেকেই । তখন আমি খুব সহজ সরল গ্রামের একটি ছেলে। মা আমাকে গরম ভাত খাওয়ানোর পর নারিকেল তেল মাথায় দিয়ে পরিপাঠি করে আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে আসে। স্কুল জীবনের প্রথম দিনটি আমার জন্য যেমন নতুন অভিজ্ঞতা ও কৌতুহলের আমার মায়েরও হয়তো তার ছেলেকে প্রথম স্কুলে পাঠিয়ে বেশ রোমাঞ্চকর। স্কুল থেকে ফিরলে মা তাড়াতাড়ি গোসল করিয়ে দিয়ে ভাত দিত। আমরা তখন মেঝেতে পাটি (মাদুর) বিছিয়ে সবাই (মা,বাবা,ভাই,বোন) একসাথে বসে খাবার খেতাম। মা পিড়িতে বসে সবার জন্য খাবার দিত আর কারো কোন পছন্দের খাবার থাকলে তাকে তুলে দিতেন। ওহ! আমার মা সম্পর্কে একটু বলি… তিনি তখনকারের এইচ.এস.সি পাস। ডিগ্রিতে ভর্তির পর বিয়ে হয়ে যাওয়ার ধরুন ডিগ্রি পাশ টা হয়ে ওঠেনি। পাড়ার অন্য বৌ-ঝিদের মধ্যে মা-ই কলেজের গণ্ডি পার হতে পেরেছিলেন। আম্মার অন্য অনেক গুণের মধ্যে অন্যতম ছিলো, তাঁর সুন্দর হস্তাক্ষর। আবৃত্তি, গান, লেখনিতে ছিলেন অনন্যা। ক্লাস ওয়ান থেকে ধীরে ধীরে আমি পঞ্চম শ্রেণিতে উঠি। মা প্রতিটা পরীক্ষার আগে আমাকে রান্না ঘরে পাটিতে বসাত। রান্নার সাথে সাথে আমার পড়াটাও আদায় করে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে তুলতেন।মমতাময়ী মায়ের শাসনের দিকও ছিলো, আমি যদি কোন পরীক্ষার প্রশ্নের পুরো উত্তর না লিখে আসতাম সেদিন দুপুরের খাবার বন্ধ থাকতো। যদিও বিকালে আবার ডেকে চোখ বড় করে খাওয়াতো আর নানান কথা শোনাতেন। যখন কোন পরীক্ষার রেজাল্ট দিত আর আমি ৮০ এর উর্ধ্বে পেতাম সেদিন আমার জন্য ভালো রান্না হত। ভালো রান্না না থাকলেও যা রান্না হত আদর করে খাওয়াতেন। যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠি তখন মা চায় আমি মাদ্রাসায় পড়ি আর বাবার ইচ্ছে স্কুলে পড়ি। আব্বার চাওয়া পূরণ হল। মায়ের কারণে কিছুটা সংস্কৃতিমনা ছিলাম। আবৃত্তি, গান, গজল এগুলোর প্রতি বেশ ঝোঁক ছিল। ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে মা বেশ সচেতন ছিলেন। যখন নামাজ পড়তেন আমাদের পাশে বসিয়ে নামাজ শিক্ষা, দোয়া দরুদ, সূরা, কখন কোন সময় কোন দোয়া পড়তে হয় সব শিখিয়ে দিতেন এবং রাতে ঘুমানোর সময় ও তিনি বিভিন্ন দোয়া শিখাতেন। তিনি রমজানে আমাদের প্রয়াত আত্মীয়-স্বজনদের জন্য প্রায় ৫-৬টি কুরআনে খতম দিতেন। বেশ ধৈর্য্যের সাথে তিনি এসব করতেন। বিভিন্ন অসুস্থতা অপেক্ষা করেও নামাজ, রোজা ও কুরআন তিলাওয়াত করতেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুলে জেলা পর্যায়ে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতার আয়োজন শুরু হয়। প্রায় ২২ টা স্কুলে মিলে হবে এই প্রতিযোগিতা। মায়ের পরামর্শে সাহস করে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলাম। স্কুলের সহপাঠিদের থেকে শুনলাম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নাকি কোন লাভ নেই। সব পুরস্কার কোয়ার্টারের (কোয়ার্টার বলতে উপজেলার সরকারি কর্মকর্তাদের বাসস্থান) আমাদের মত সাধারণ পরিবারের ছেলে মেয়েরা সেখানে অংশ গ্রহণ করলেও ভালো কিছু করতে পারতো না। আমাদের সাথে যারা কোয়ার্টারের ছেলে মেয়েরা পড়তো তারা সবাই প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হতো। যা-হোক তবুও আমি হাল ছাড়লাম না। আমি এবং আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় রাহুল রায় মিশু অংশগ্রহণ করলাম। ২২ টা স্কুলে শতাধিক প্রতিযোগি অংশগ্রহণ করল। আমি কবিতা আবৃত্তি ও নজরুল সঙ্গীতের অংশ গ্রহণ করলাম। অনুষ্ঠানের আয়োজকরা একটা কবিতা সবার জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়। কবিতাটি ছিল ‘রবীন্দ্রনাথের’ “তোমার পতাকা যারে দাও”। মা আমাকে দিন-রাত করে এই কবিতাটি খুব ভালোভাবে শেখায় ।ফলে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের মতো আমাদের স্কুল থেকে আবৃত্তিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করি। স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও প্রথম দ্বিতীয় হতাম প্রায়। তখন আমার বাবা একটা কলেজের প্রধান সহকারি ছিলেন। যা বেতন পেতেন তা আমরা চার ভাই ও এক বোনের পড়ালেখার খরচ ও সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। আর বাবাকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট দিতেন মা। আমাদের পুরো পরিবারে অস্তিত্ত্ব জুড়েই ছিলেন আমার মা। যেদিন রান্না কম হতো কিংবা যথেষ্ট খাবার থাকতো না সেদিন তিনি তার খাবারের অংশটুকু আমাদের খাওয়াতেন এবং এমন ভাব করতেন যে তিনি এমন ভাবে খেয়েছেন যেন কয়েক বেলা না খেয়ে থাকতে পারবেন। আমাদের বলতেন, আমি নামাজ পড়ে খাবো বা আমার ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুম থেকে উঠে খাবো। কতই না মিথ্যা অভিনয় করতেন মা। আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারে ছিলেন বেশ সচেতন। প্রাইভেট বা কোচিং দিতে না পারলেও তিনি নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে পড়ালেখা করানোর চেষ্টা করতেন। আমাদেরকে বড় করে মানুষের মত মানুষ করার, সম্মানের পাত্র বানানোর জন্য যেন তার সৃষ্টি। আর যদি কোনো কোচিং বা স্যারের কাছে পড়তে চাইলে, তিনি না করতেন না। মাস শেষে শিক্ষকদের বেতন কোত্থেকে আসবে সেই চিন্তা করতেন না। আমরা যেন ভালো স্যারের কাছে পড়ে ভালো রেজাল্ট করি এই চিন্তাতেই বিভোর থাকতেন।তবে মাস শেষে কোচিং বা স্যারের বেতন দেয়ার কষ্ট দেখে আমি কোন কোচিং বা স্যারের কাছে পড়ার আবদার করতাম না।
এসএসসি পাশের পর কলেজে ভর্তি হলাম। শুরু হল আমার টিউশনের জীবন।টিউশন, কোচিংয়ে ক্লাশ নিয়েই পড়াশোনা ও নিজের খরচ মেটাতে লাগলাম।স্বনির্ভর জীবনের শুরুতেই শুরু হল মায়ের অসুখ। বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধতে লাগলো মায়ের শরীরে। মা এসব রোগকে বেশি পাত্তা দিতেন না।কারণ রোগের চেয়েও আমাদের বড় করার স্বপ্নে তিনি বিভোর ছিলেন। এইচএসসি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। বাবাও অবসরে গেলেন। বোনের বিয়ে হলো। বড় ভাই থেকেও নেই। পরিবার আস্তে আস্তে আমার উপর নির্ভরশীল হতে লাগল। টিউশন, ব্যাচ পড়ানো, কোচিংয়ের ক্লাস আমার কাছে নেশার মতো হয়ে উঠল। মায়ের অসুখও পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো। আমাদের কষ্ট হবে বলে মা রোগের কথা গোপন করতেন। অসুস্থতার জন্য কাছের কোন স্বজন আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতেন মা সেসব সংসারের পেছনেই খরচ করে ফেলতেন। পাড়ার সকল সামাজিক কাজে কিংবা আত্মীয়-স্বজনের যে কোন অনুষ্ঠানে তিনি রোগ উপেক্ষা করে যেকোন আনুষাঙ্গিক কাজে সহযোগিতা করতেন। কায়িক শ্রম দিয়ে যেকারো কাজে বা উপকারে তিনি সচেষ্ট ছিলেন।
নিম্ম মধ্যবিত্ত হওয়াতে অনেকের অবহেলার পাত্র ছিলাম।অনেকের তীর্যক বক্তব্য আমাকে এখনও আঘাত করে। তাই আম্মার এই অসুস্থতার সময়েও কোন স্বজনের দ্বারস্থ না হওয়ার চেষ্টা করতাম। একদিন বড় দুঃসবাদটি পাই। মায়ের ব্রেস্ট ক্যান্সার! কথাটা শোনার পর আমার পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যাচ্ছিল। বিভিন্ন ডাক্তারের শরণাপন্ন হই, নানান দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হয় আমার। ডাক্তারের পরামর্শে আম্মাকে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি দিতে থাকি। আবার কখনো হার্টের ডাক্তার, কখনো সার্জারির, কখনো ডায়বেটিসের ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়।
ক্যান্সার হওয়ার পর মায়ের আচরণ অনেকটা বাচ্চা শিশুর মতো হয়ে যায়। আমাকে বার বার বলতেন, ‘ভালো করে পড়ালেখা করিস আর তোর ছোট ভাইদের প্রতি খেয়াল রাখিস।’
আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম মা’কে সুস্থ করার জন্য। টিউশন, কোচিং থেকে যা পায় তা-ই মায়ের পেছনে খরচ করতে লাগলাম। শেষ মুহূর্তে আত্মীয় স্বজনরাও কিছু আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ছিল না। আমি মাকে সবসময় সাহস দিতাম যেমনটা ওনি আমাকে দিতেন। বলতাম ওনাকে শিগ্রই ইন্ডিয়া নিয়ে যাবো। ওখানের ডাক্তারের সাথে আমার কথা হয়েছে, আপনি ভাল হয়ে যাবেন। অনেক ঝামেলা চুঁকিয়ে আমার আর মায়ের পাসপোর্ট বানিয়ে ফেললাম। যেদিন আমার পাসপোর্টটা অফিস থেকে সংগ্রহ করার জন্য মোবাইলে মেসেজ এলো সেদিন ছিলো ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ। মা তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি । পাসপোর্ট সংগ্রহ করার জন্য মেডিকেল থেকে বের হয়ে কিছুদূর আসতেই আমার ছোট ভাই আদিব বার বার কল দিতে লাগল। বললো আমি যেন অতিদ্রুত মেডিকেলে আসি।দ্রুত সিএনজি ট্যাক্সি নিয়ে মেডিকেলে আসলাম। এসে দেখি মা নেই।সবাই তখন চিৎকার করে কাঁদছে। কিন্তু তবুও মন সায় দিচ্ছিল না। বিশ্বাস হচিছলো না মা নেই।আমি চিৎকার করে ডাক্তারকে ডেকে আনলাম। উদভ্রান্তের মতো বলছিলাম, ‘‘আমার মা’কে ঘুম থেকে তুলেন, আমাদের পাসপোর্ট রেডি। আমি জরুরি ভিসা নিয়ে আমার মা-কে ইন্ডিয়া নিয়ে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করাবো’’।
আমার মা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে সবার কষ্টকে দূর করে আমাদের দুশ্চিন্তামুক্ত করে দিলেন। রান্নাঘরে মায়ের ঘামে ভেজা সেই গন্ধ, শাড়ির আঁচল আমরা এখন আর পায় না। খেয়েছিস? এতো দেরি হলো কেন? পড়ালেখা করে যখন বড় চাকরি করবি তখন ঈদে আমাকে একটা দামি শাড়ি কিনে দিস। এমন প্রশ্ন আবদারগুলো কেউ করে না।নিজের সব সমস্ত অতৃপ্তি নিয়ে সমস্ত স্নেহ আমাদের জন্য রেখে সারাজীবনের জন্য ঘুমিয়ে গেছেন মা। কবি ইমতিয়াছ মাহমুদের একটি কবিতা পড়লে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে।- “আমি তত দূর যাব ঢেউ যত চায়,
মায়ের কবরে এসে নদী থেমে যায়!
সত্যিই, আমার সমস্ত কিছু এসে মায়ের কবরে থেমে যায়।
আজকের মা দিবসে পৃথিবীর সকল মায়ের প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা, নিরন্তর ভালোবাসা। প্রতিটি সন্তান তার মায়ের আঁচলে খুঁজে পাক জীবনের শ্রেষ্ঠ ভালবাসা ও মমতা।
ভালোবাসি মা, অনেক বেশি!!!
লেখক: তানভীর আহমেদ সিদ্দীকি
সংগঠক ও শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়