৯৯তম মৃত্যুদিবস স্মরণে- শেখ-ই চাঁটগাম কাজেম আলী মাস্টার

“শেখ-ই চাঁটগাম কাজেম আলী মাস্টার” চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের একজন বরেন্য কৃতি সন্তান, এই উপমহাদেশের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব ‘‘শেখ-ই চাঁটগাম’’ নামে সুপরিচিত। এটা উনার পিতা মাতার দেয়া নাম নয়, বংশ পরিচিতিও নয় কিংবা এটি কোন সরকার বা রাজ-রাজার প্রদত্ত উপাধি নয়, বরং এটি তার ব্যক্তিত্বের উপাধি। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে সেবা ও ধর্মের এক মহাপ্রতিভা হিসেবে তিনি যে আত্মদান করেছেন তার স্বীকৃতির এক অমুল্য প্রতিদান দেশবাসীর দেওয়া উপাধি ‘শেখ-ই চাঁটগাম’। কাজেম আলী মাষ্টারের জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে যখন আমরা পেছনে ফেলে আসা দিনগুলো চোখ বুলাই তখন দেখি উনার জন্ম এক মহা বিভিষিকাময় পরাধীনতার অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে। সমগ্র দেশ জুড়ে ছিল ইংরেজ রাজশক্তির ত্রাসের রাজত্ব। গোটা জাতি ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। কাজেম আলী মাস্টার ১৮৫২ সালের ১১ আগষ্ট চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটস্থ ফরিদেরপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। কাজেম আলী মাস্টারের সারাটি জীবন ছিল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ভিতর দিয়ে সমাজ সেবা ও সর্বোপরি পরাধীনতার বন্ধন মুক্ত করে দেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা। কাজেম আলীর পিতার নাম মুন্সি কাসিম আলী, তিনি তৎকালীন সময়ে একজন স্বাধীনচেতা উকিল পরে মুন্সেফ ছিলেন, তার উকালতির আয়ও ছিল খুব ভাল। ফরিদে পাড়া এলাকায় বিখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক হযরত শেখ ফরিদ চশমা (রাঃ) স্থপয়িতা বলে অনুমান করা হয়। তারা শেখ ফরিদ (রঃ) এর বংশধর। কাজেম আলীর বাবারা ছিলেন তিন ভাই। ১. কাসিম আলী, ২. উজির আলী, ৩. আক্কেল আলী। উজির আলীর কর্মজীবন তৎকালীল সেনা বিভাগের একজন সুবেদার ছিলেন। পরে আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হয়ে সংসার ত্যাগী হন। বর্তমানে দক্ষিন বাকলিয়া মাস্টার পুলস্থ কাজেম আলী মাস্টার বাড়ি ভিটায় কাজেম আলী মাস্টার জামে মসজিদ সংলগ্নে তাঁর মাজার শরীফ বিদ্যামান। অপর ভাই আক্কেল আলী মুক্তারি পেশায় যুক্ত ছিলেন এবং তিনি অকালে মৃত্যুবরণ করেন। কাজেম আলীর বয়স যখন নয়মাস তখনই মা ’চান্দবিবি’কে হারান এবং পরে নিঃসন্তান চাচা উজির আলীর স্নেহে পালিত হন। পিতার সংসার থাকলেও তিনি চাচার দায়িত্বে বড় হন। ভারতে ব্রিটিশ রাজ্য শুরুর প্রায় একশ বছর পর্যন্ত মুসলমানেরা ইংরেজী শিক্ষার প্রতি ভীত শ্রদ্ধ ছিলেন। শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে থেকে পরবর্তীতে তারা আবার ইংরেজী শিক্ষা গ্রহনে আগ্রহী হন। কিশোর কাজেম আলীর মক্তবে পড়া শেষে স্কুলে দেয়া হল। কিন্তু কিছুদিন পর তার স্কুলে যাওয়ার প্রতি অনীহা লক্ষ কর গেলে তার পিতা তাকে স্কুলে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন ”আমি আর স্কুলে যাব না” তখন পিতা রাগের মাথায় তাকে হালচাষ করতে নির্দেশ দিলে তিনি সত্যি সত্যিই হালচাষ করতে গেলেন। পরে যখন জানা গেল যে স্কুলে অন্যান্য ছেলেদের আচরণ তিনি সহ্য করতে না পেরে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছেন, তখন পিতা তার এমন আচরনের কারণে তাকে হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের হুগলী শহরে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তিনি আধুনিক শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। মুসলমানদের জন্য তখন হুগলীর শিক্ষাই ছিল ভাল। হুগলী থেকে কাজেম আলী এন্ট্রাস পাশ করে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। শুরু করেন সংস্কৃতমন নিয়ে কর্মময় জীবন। প্রথমে তিনি সাতকানিয়ায় একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি সেখানে বেশীদিন থাকলেন না। দেশকে তিনি জাগিয়ে তোলার তাগিদ অনুভব করেন অন্তরে এবং মনস্থ করলেন শহরে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে দেশের মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করবেন। শিক্ষিত হবে জনগন ও দেশ, সেই লক্ষ্য পুরনে ১৮৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের দক্ষিন পাশে হযরত মৌলানা মিসকিন শাহ (রাঃ) এর মাজারের পূর্বপাশে চাকমারাজা থেকে প্রায়ই ৫.৭ কানি জমি খরিদ করে স্থাপন করলেন চিটাগাং মিডল ইংলিশ স্কুল এবং তিনবছর পর ১৮৮৮ সালে স্কুলটি হাই স্কুলে উন্নীত হয়। কাজেম আলীর দুই ভাই- আক্কেল আলী ও মনোহর আলী এই স্কুলের শিক্ষক এবং কাজেম আলী স্বয়ং প্রধান শিক্ষক হলেন। এই স্কুলে গরীব ছাত্রদের সুবিধার জন্য ছিল স্বল্প বেতনের ব্যবস্থা। বিনা বেতনের ছাত্রও ছিল খুব বেশী সংখ্যক। সে সময় কাজেম আলী সপরিবারে ফরিদের পাড়া থেকে দক্ষিন বাকলিয়ায় স্থানন্তরিত হয়ে এল। যে বাড়ি বর্তমানে কাজেম আলী মাস্টারের স্মৃতি বহন করে ঐতিহ্যবাহী “কাজেম আলী মাস্টারবাড়ি” নামে সুপরিচিত রয়েছে। তার বংশধরগণ এই বাড়িতে বসবাস করছেন। তার জীবদ্দশায় অনেক চেষ্টা করেছিলেন ওনার প্রতিষ্ঠিত চিটাগাং মিডল ইংলিশ স্কুলটি কাজেম আলী মাস্টারের নামে নামকরন করা কিন্তু উনি অনীহা প্রকাশ করায় ব্যর্থ হলেন সবাই। তার মৃত্যুর পর ১৯২৮ সালে এই স্কুলের নতুন নামকরণ করা হলো কাজেম আলী হাই স্কুল। বর্তমানে তা কলেজে উন্নীত হয়। কাজেম আলী ছিলেন তেজী, স্বাধীনচেতা এবং সাম্রাজ্যবাদের আপোষহীন সোচ্চার সংগ্রামী নেতা। ১৮৯৩ সালে কাজেম আলী চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এই পদে বহাল ছিলেন। ১৯০৩ সালে বৃটিশ সরকার কাজেম আলীকে খাঁন বাহাদুর উপাধি দানের চেষ্টা করলে তিনি তা প্রত্যাখান করেন। পরবর্তীতে জনসেবার নিঃস্বার্থ কর্মী হিসেবে”কায়সার-ই-হিন্দ” গোল্ড মেডেল ও সার্টিফিকেট অফ অনার প্রদান করা হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক ভাবে দানা বাঁধে। এই সময় থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে বৃটিশ বিরোধী ভুমিকায় অংশগ্রহন করে। অত্র অঞ্চলে স্বদেশী আন্দোলনকে জোরদার করে তোলেন। এই সময় তিনি ভারতের বিশিষ্ট খ্যাতিমান পুরুষ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী, চট্টগ্রামের দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেন প্রমূখদের সহচর্য লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯১১ সালে সম্রাট ৫ম জর্জের অভিষেক অনুষ্ঠানে তাকে ২য় বারের মত ’কায়সার-ই-হিন্দ” উপাধি দেয়া হয়। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ভুমিকায় কাজেম আলী কংগ্রেস মুসলিম লীগ, খেলাফত ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। এসময় তিনি দেশের প্রতি ভালবাসার নিদর্শন সরূপ সরকারী খেতাব ”কায়সার-ই-হিন্দ” গোল্ড মেডেল বর্জন করেন। ১৯১৩ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কংগ্রেস খেলাফত দুর্বার জাতীয় আন্দোলনে গড়ে তোলার সময় চট্টগ্রাম এক বিশাল সভায় জনতা তাকে ”শেখ-ই-চাঁটগাম” উপাধি দিয়ে অভিনন্দিত করে। ১৯২১ সালে ধর্মঘট ও শোভাযাত্রা করার অপরাধে অন্যান্য কয়েক নেতার সাথে তিনি কিছুকাল সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করেন এবং এই বছরেই তিনি কংগ্রেসের টিকেটে চট্টগ্রাম থেকে তিনি ভারতীয় আইন পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২৬ সালে দিল্লীতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করেন । অধিবেশনে জোড়ালো বক্তব্য উপস্থাপন করা কালে হঠাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে অধিবেশন চলাকালীন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এই দিনটি ছিল ১২ ফেব্রুয়ারি। তার মৃত্যু সংবাদে চট্টগ্রাম তথা সারাদেশে শোকের কালো ছায়া নেমে আসে। তার মৃতদেহ দিল্লীর শাহী জামে মসজিদের জাতীয় কবরস্থানে শেখ-ই চাঁটগাম কাজেম আলী মাস্টার নামফলক সহকারে সমাহিত করা হয়। কাজেম আলী হাই স্কুল এন্ড কলেজ,কাজেম আলী রোড,কাজেম আলী মাষ্টার বাড়ি, কাজেম আলী মাষ্টার বাড়ি জামে মসজিদ, কাজেম আলী মাস্টার পুল মরহুমের স্মৃতিবহন করছে।