আজ ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
হারিয়ে খুঁজি প্রিয় বাবাকে!
সাফাত বিন ছানাউল্লাহ্
আগষ্টের দুইমাস পেড়িয়ে এখন নবেম্বর। শোকের কিছুটা মাঝবিরতি। আবার শোককে সঙ্গী করে ৩০ টা দিন পার করা। কত সেকেন্ড! কত মিনিট! কত ঘন্টা! কান্নার জল অবিরত বর্ষণ হয় সারা বছর।
২০১২ সালের নবেম্বরের এই সময়টা ভালই যাচ্ছিলো। বোধহয় একটু শীতল ভাব চারদিকে। ক্যালেন্ডারের পাতায় কেন লেখা হল ২৭ তারিখ।১২,১৩,১৪,১৫,১৬,১৭,১৮,১৯ আট বছর পেড়িয়ে এখন নতুন শরৎ এর আগমনী বার্তা। আর কিছুদিন পর আবার সেই ২৭ নবেম্বরের হাতছানি। যেদিনটি মনে রাখতে চাইনা কিছুতেই। সৃষ্টিকর্তার নিয়মে ১১ মাস পরপরই চলে আসে বারবার। তখন নিজেকেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত করি – আরেকটা দেখার আগে আমিও কেন ২৭ এ হারাইনা!
প্রতি বছর নির্দিষ্ট একটি দিনে” বাবা দিবসে ” সবাই আপন বাবাকে যখন শুভেচ্ছা জানায়, হাত ধরে ঘুরতে যায়, মমতা/আদর নেয় তখন বড়ই কষ্ট হয়! বুকটা ছিড়ে যায়! আট বছর আগেও বাবা দিবস ছিল আমার কাছে উৎযাপনের মাধ্যম। প্রতিটি দিন ছিল আমার বাবা দিবস। ঘটা করে একটি দিন পালন করার পক্ষে নই আমি! দিনটি প্রতি বছর আসে, কেন জানি আজ তা অর্থহীন। তবুও আবছায়া হয়ে আমার আশেপাশে থাকা প্রিয় বাবাটাকে খুঁজে বেড়াই দৃশ্যমান বাবাগুলোর মাঝে! ঘাসের শিশিরজলে! প্রকৃতির নিস্তব্ধতায়।
বাবার তুলনা তো তিনিই। এই বিশাল ধরার কারো বাবার কথা জানিনা, আমার বাবা ছিলেন সবার থেকে আলাদা একজন। সন্তানের কাছে তিনি ছিলেন একজন বন্ধু, সহপাঠী, অভিভাবক জানা অজানার শেষ আশ্রয়স্থল।
আমাদের বাড়ীটা ছিল নির্দিষ্ট এক ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে। আমার দাদা থেকে শুরু করে ওনার দাদারা সকলেই ছিলেন বড় মাপের আলেম ও পীর সাহেব। দাদাজানের কাছ থেকে বাবাও কিছু তালিম নিয়েছিলেন ঠিকই কিন্ত, তিনি ওতপ্রোত ভাবে নিজেকে জড়াননি সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন বলে। একজন নির্মল, প্রাণোচ্ছল সাদা মনের মানুষের পাশাপাশি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন মুক্ত মানুষ। কথাগুলো যখন কিবোর্ডে টাইপ করছি দুচোখ আবছা হয়ে আসছে বারবার।
সত্যি বলছি – সেই শিশু থেকে আমি ছেলেটা খুব একটা ভাল ছিলামনা। জানা-অজানায় অনেক ছোট খাটো অপরাধ করতাম প্রতিনিয়ত। বাবা! শাষন করতেন আবার অবাক করা বন্ধনে আড্ডা জমাতেন যেন তাঁর জনম জনমের সখা। একসাথে বসলে কয়েকঘন্টার জন্য ভুলতেন তিনি সন্তানের সাথে কথা বলছেন। গান, কাওয়ালী, গল্প আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনাতেন। কোন জায়গায় বেড়াতে গেলে নতুন জায়গার বর্ণনা দিতেন নিখুঁতভাবে। আমিও গাড়ীর পাশাপাশি সিট থেকে বিরক্ত করতাম, জিজ্ঞেস করতাম বাবা! ও বাবা! – এই হাটটার নাম কী? এই জায়গাটার নাম কী? এটাকে কী বলে? ইত্যাদি…….. বাবা অদ্ভুত আবদার উপভোগ করতেন আর উত্তর দিতেন।
ওনার বিয়েতে আলতু ভাইয়া, রিপন ভাইয়ারা (ফুফাতো ভাই) কাদামাখা মাখি, জলকেলি আর দুষ্টুমির সেই পৌরাণিক কাহিনীও অকপটে শেয়ার করতেন লজ্জা ভুলে। মনে হয় তিনি আজো আছেন। হ্যা এইতো তিনি! বাবা, তুমি কোথায়? ফিরে এসোনা একটিবার। এখনও তোমার প্রতিক্ষায় প্রতিটি রাত কাটে নির্ঘুম। জান বাবা- আমি এখনও আগের মতই আছি। প্রতিটা সেকেন্ডে তোমার মায়াভরা মুখখানি আমার চোখের সামনে ভেসে উটে। রাতের নির্জনতায় তোমার নতুন সুখের ঘরের কাছে গিয়ে বসি, এতদিনের জমানো কথাগুলো বলতে ইচ্ছে জাগে খুব।
আঁট বছর আগে তো সব ছিল। কোলাহল, আনন্দ, খুনসুটি সব। আদি শিল্পীদের নিপুণ হাতে গড়া একটি মাটির ঘর ছিল, পাশেই ঘরটির ছায়া বিলানো হরিতকী গাছ ছিল, সামনেই কাছারি ঘর, পিছনে ভরা মাছের পুকুর, গ্রামীণ সহজাত পরিবেশ ছিল। আজ আর কিছুই নেই। সবকিছু হারিয়ে গেছে জাগতিক নিয়মে বাবার সাথে। আমারও বাউণ্ডুলিপনা কমেছে খানিকটা। তুমি যখন অফিস করে শহর থেকে আসতে, গাড়ী থেকে নামার সাথে পকেটে গুঁজে থাকা পেপার নিয়ে দৌড়ানি ভুলেই গেছি। আবার যখন রাগ অভিমান ভুলে বাড়িতে এসে চেয়ারে বসতে আমিও চুপিচুপি পাশে বসে নানান বিষয় প্রশ্ন করার ফাঁকে গল্প জুড়াতাম সেই স্মৃতিও আবছা সময়ের সাথে। দিনগুলোর কথা মনে করার চেষ্টায় প্রতিনিয়ত অতিবাহিত করি সময়। চলে যাই বাবার নতুন ঘরটায়।
ঘেরাওয়ের ওপাশে বাবা এপাশে আমি। বহুদিনের জমানো কথাগুলো নিয়ে রচনা করা হচ্ছে – নিশিকাব্য। বিষয় – ” চোখের জল ” কত কথা! কত আড্ডার ফাঁকে পুরোন দিনের স্বৃতি রোমন্থন। ভিনগ্রহে থেকেও পৃথিবীর এই আমি’র সাথে সন্তান স্নেহে আলিঙ্গন করেন আজও। চোখগুলার বাঁধভাঙা অশ্রুকণাকে যখন চাইলেও আটকে রাখতে পারিনা তখন আশ্বাষ দেন।
আমার শুধু বাবার প্রতি একটাই অভিযোগ – একা কেন গেলে ওই অচিনপুরে ? বাবা কেন ? যখন আনন্দ-কোলাহলের দিনগুলোতে কোন অন্যায় বায়না ধরতাম না পারলেও চেষ্টা তো অন্তত করতে পূর্ণ করার। নিজের বেলায় ষোলআনা তাই না!
দেখেছ – আকাশে কত সুন্দর ছোট চাঁদ, সাথে হাজারো তারা! ওরা কিন্ত, আমাদের সব কথা শুনে ফেলছে। চারদিক এখন নিস্তব্ধ শুধু দুর থেকে আবছা আওয়াজ আর কতক পোকার ঝিঁঝিঁ শব্দ। রাতের নিস্তব্ধতা আর সমুদ্রের মত উত্তাল, চাঁদের আলো তাঁর রূপ করেছে অবর্ণনীয়। দুরের দেশ থেকে আরেকবার তুমি একটিবার আদর করতে আস বাবা! না হলে আমায় নিয়ে যাও বেড়াতে, খুব স্বাদ জাগে প্রিয় জন্মদাতার আলতো হাতটা ধরে ক্রোশের পর ক্রোশ হাটব আর এটা/ওটা বায়না ধরব !
আজ দেখতে দেখতে আটটি বছর কেটে গেছে, বাবার হাতটা ধরি না। দেখি না সেই ভুবনজয়ী হাসি,
খাবার টেবিলে আড্ডাটা আর জমে না। আমার সবচাইতে প্রিয় বন্দুটির সাথে সবকিছু শেয়ার করা হয়না!
অফিস থেকে আসার সময় হাতে ধরে রাখা
পেপারটি নিয়ে দৌড় মারিনা অনেকদিন!
১ টাকার চকলেটের বায়না চাইলেও আর ধরা যায়না, যেটা তোমার প্রতিদিনের রুটিন ছিল।
ছয় বছর আগেকার সেই অপয়া রাতের কথা এখনো দুচোখে স্পষ্ট। সিএনজিতে ওটার সময় বাবার শেষ কথাগুলো আমাকে আর ভাইদের ইশারা করে –
“ডাক্তার দেখিয়ে রাতে অথবা সকালে চলে আসব। ঘরটা দেখিস। আমি, তোদের মা আর ঐশি যাচ্ছি” এখনো প্রতি মুহূর্তে এক নদী অশ্রু বইয়ে কানে বাজে। বাবা সেই রাতে আর ফিরলেননা শান্তি, সুখের ছায়ানীড়ে। গুরুজন মুখে শুনেছিলাম আর বইয়ে পরেছিলাম – ভাল মানুষদের নাকি সৃষ্টিকর্তা আগেই সবার আগেই ওনার কাছে ডেকে নেন।